আপনার বয়স চল্লিশের বেশি হয়া থাকলে মিম জিনিসটার সাথে পরিচয় থাকাটা বিরল। আর বয়স পঁচিশের কম হইলে পরিচয় না থাকাটাই বরং বিরল অর্থাৎ মিম কী জিনিস ব্যাখ্যা না করলেও চলে। তাছাড়া জোক, স্বপ্ন বা টিনেজ কালচার ব্যাখ্যা করার মতো, মিম ব্যাখ্যা করাও বেশ ‘আনকুল’ ব্যাপার। ব্যাখ্যায় আয়াস লাগে; অথচ যে আর্ট ফর্ম ‘অনায়াস’ দেখাইতে সদা সচেষ্ট তারে ব্যাখ্যা করা আর রামগরুরের ছানা হওয়া একই কথা। তবে রামগরুরের ছানা বা অতিশয় সিরিয়াস হইতে আমার আপত্তি নাই। সিরিয়াস প্রবন্ধ লেখার একটা চালু তরিকা আছে। যেমন: প্রবন্ধের চাবি-শব্দ ধরে কিছুক্ষণ বাতেলা দিতে হবে। কই থেকে শব্দটা আসলো? আদি উৎস থেকে কীভাবে শব্দটার বিবর্তন ঘটছে? অভিধানে একটু ঘোরাফেরা করে এসে হালকা পাণ্ডিত্য জাহির করা আরকি। সেই তরিকা অনুসরণ করা যাক।
মিম জিনিসটা ইন্টারনেটের বাইরে কল্পনা করা কঠিন অথচ মিমের ধারণা ও মিম শব্দটার বয়স কিন্তু ইন্টারনেটের চাইতেও বেশি! দুনিয়া অবারিত তথ্যের এক সমুদ্র। তথ্য বা আইডিয়া মানুষের জিনের মতো আচরণ করে। আইডিয়া ছড়ায়, আইডিয়া অন্য আইডিয়ার সাথে মিথষ্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়, ফলে বদলায় এবং নতুন নতুন আইডিয়ার জন্ম দেয়। কিভাবে সাংস্কৃতিক তথ্য বৃহত্তর সমাজে ছড়ায়ে পড়ে, আর বদলাইতে থাকে, তা ব্যাখ্যা করতে চাইছিলেন ব্রিটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স। তার মতে, ‘সকল প্রাণীর কেন্দ্রে তপঃ নাই, নিঃশ্বাসের উত্তাপ নাই, জীবনের স্ফূরণও নাই। মৌল বিষয় হইতেছে তথ্য, শব্দ, নির্দেশনা।’ ডকিন্স আরও বলতেছেন, ‘জীবনরে বুঝতে চাইলে, জীবন্ত, ছটফটানো জেলি ও পিছ্লা ভ্রুণের কথা ভাইবেন না, চিন্তা করেন তথ্যের প্রযুক্তির কথা।’
যেহেতু কোনো কনসেপ্ট— একটা আইডিয়া, স্টাইল বা যেকোনো ধরণের আচরণ— যা কোনো সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে; যেহেতু প্রক্রিয়াটা মানুষের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য ট্রান্সমিশনের মতই, ডকিন্স একাক্ষরের একটা শব্দ খুজতেছিলেন যা জিন -এর সাথে অন্তমিল রাখে। এক পর্যায়ে তিনি গ্রিক শব্দ mimeme (যা অনুসৃত হয়) খুজে পান আর তার বিখ্যাত বই সেলফিশ জিন-(১৯৭৬) এ রিচার্ড ডকিন্স ‘মৌল’ এই বিষয়টার নাম ডকিন্স দিছেন, mimeme। কথাটারই সংক্ষিপ্ত রূপ তথা meme (আমার অনুমান ‘সেলফিশ জিন’ বা ‘রিলিজিওসিটি’ ধরণের নামকরনের চাইতে ভবিষ্যতের মানুষ ডকিন্সরে মনে রাখবে মূলত ‘মিম’ শব্দটার উদ্ভাবক হিসেবেই)। পরে মাইক গডউইন ১৯৯৩ সালে মেসেজবোর্ড, ইউজারনেট বা ইমেইলে ছড়ানো মিম ব্যাখ্যা করতে গিয়া ইন্টারনেট মিম কথাটা চালু করেন।
এই লেখায় কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমরা বিস্তারিত জানা-বোঝার চেষ্টা করবো।
মিম কিভাবে কাজ করে?
মিমের স্বভাব-চরিত্রই বা কেমন?
মিমের সামাজিক প্রভাব—বিশেষত পপুলার কালচারে—কীরকম?
জোকের সাথে মিমের মিল-অমিল থাকলে সেগুলো কেমন?
অনাগত দিনগুলিতে মিমের স্বভাব-চরিত্রের গতিপথ কোন দিকে যাইতে পারে?
আসেন, শুরু করি।
মিম কী?
মিমের একখানা সংজ্ঞা একান্ত দিতে হইলে এইভাবে বলা যায়: মিম, মোটাদাগে, দৃশ্য মাধ্যমের এক ধরণের ইনসাইড জোক। চিকনদাগে আরও অনেক কিছু, তবে মোটাদাগের সংজ্ঞাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে। তো, আর্টফর্ম হিসেবে ইন্টারনেট মিম মূলত ভিজুয়াল জোক বা দৃশ্য মাধ্যমের কৌতুক। আর ভিডিও মিম হইতেছে অডিও-ভিজুয়াল জোক। এইভাবে দেখলে মিমের সোশ্যাল বা রাজনৈতিক মাত্রা ও পরিণাম শনাক্ত করা সহজ। জোকে, যেমন– ১টা প্রেক্ষিতবিন্দুর (রেফারেন্স পয়েন্ট) সাথে আরেকটা প্রেক্ষিতবিন্দু জাক্সটাপোজ করা বা একসঙ্গে বসানো হয়, মিমেও সেইটা হয়। ২টা ভিন্ন প্রেক্ষিতের তাৎক্ষণিক বা অভাবনীয় মিলন মজাটা তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন প্রসঙ্গে বলছেন কিন্তু হাস্যরস মৌলপ্রবণতা সম্পর্কে তার অনুমানও কাছাকাছি: ‘হাস্যরসের প্রধান দুইটি উপাদান অবাধ দ্রুতবেগ ও অভাবনীয়তা’ (রবীন্দ্রনাথ: ছন্দ | বাংলা ছন্দে অনুপ্রাস)। এই অভাবনীয়তা প্রেক্ষিতগত সার্প্রাইজ বা চমক থেকে তৈরি হয়। মিমের সাথে জোকের তফাৎ হইতেছে মিমে টেক্সটের পাশাপাশি ইমেজ বা (ভিডিও মিমের ক্ষেত্রে) মুভিং ইমেজ যুক্ত হয়ে বৈচিত্র্য ও পরিসর আরও বাড়ায়ে দেয়।
জোকের যে পলিটিক্স বা সামাজিক পরিণাম থাকে মিমের ক্ষেত্রেও তেমনই থাকে। মিমের ক্ষেত্রে, বিষয়টা—এহেম —মিমেটিক অর্থাৎ সাধারণ জোকের চেয়ে লোকের মধ্যে ছড়ায়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এ কারণে ভাইরাল বা পপুলার ইমেজের মিমেটিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু শেষপর্যন্ত মিম জোকই—পুনরাবৃত্তিযোগ্য এবং পুনরায় নির্মাণযোগ্য জোক। এ কারণেই মিম একটা হাইব্রিড মিডিয়াম— যেখানে সাধারণত ২টা মিডিয়াম (টেক্সট ও ইমেজ/মুভিং ইমেজ) একত্রে হাস্যরস সৃষ্টি করে। মিমে ভিজুয়াল বা ইমেজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, টেক্সটের চাইতে। কেন? কারণ, আপনি টেক্সট ছাড়াও মিম বানাইতে পারবেন কিন্তু ইমেজ ছাড়া খালি টেক্সট দিয়া মিম বানাইতে পারবেন না; সেইটা লিখিত জোক হবে।
জোকের সাথে মিমের মাত্রাগত ভিন্নতাও আছে দৃশ্য মাধ্যমের বইলা টেক্সটের চাইতে মিমে স্বাভাবিক নমনীয়তা বেশি। অবশ্য জোকের বা মিমের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনা যেমন আছে, ডমিন্যান্ট মতাদর্শের পলিটিক্সের বাহন হওয়াও আছে (জোকের বড় একটা অংশ মূলত শ্রেণিবিদ্বেষ ধারণ করে)।
মজার কোনো ইমেজে উইটি ক্যাপশন থেকে ভাইরাল চ্যালেঞ্জ, চলতি বুলি (ক্যাচফ্রেজ) এমনকি নাচও মিম হইতে পারে। ইন্ডিয়ার সোহম ও মিমি চক্রবর্তী অভিনিত ‘বোঝে না সে বোঝে না’ (২০১২) মুভির ‘নারে নাহ, নারে না ’ নামে একটা হিট গানে নির্দিষ্ট ঢংয়ে নাচের ভঙ্গিটাও আসলে একটা মিম। একইভাবে ইউটিউবের প্রথম গ্লোবাল হিট সং সাই-এর গ্যাংনাম স্টাইল-এর ড্যান্স মুভও মিম। মোদ্দাকথা, সাংস্কৃতিক পরিসরে যার ব্যাপক পুনরুৎপাদন ও পুনর্নিমাণ ঘটে, তারেই মিম বলা যায়।
মিমের স্বভাব-চরিত্র
একের সাথে অন্যের মিলমিশের, প্রত্যয়গত (কনসেপ্টুয়াল) ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে এমনকি বিপরীত প্রেক্ষিতের আইডিয়ার মিশেল অর্থাৎ নানান অদ্ভুতুড়ে রিমিক্সিং মিম কালচারের মূল বৈশিষ্ট্য। কালচারে মোটাদাগে এই প্রবণতারে অনেক ক্রিটিক বলেন ‘মেটামডার্নিজম’। মানে হইতেছে মডার্ন সিরিয়াসনেসের সঙ্গে পোস্টমডার্ন আইরনি বা পরিহাসময়তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া। ফলস্বরূপ আশা ও নিরাশা, এমপ্যাথি ও এপ্যাথি, একত্ব ও বহুত্বের পরিষ্কার অবস্থান দেখা যায় না, চলতে শুরু করে অবিরাম ভাব ও ব্যাঞ্জনাগত দোলাচাল। ইন্টারনেটের দুনিয়া কালচারের এই মেটামডার্ন সেন্সিবিলিটি দিয়া ব্যাপকমাত্রায় প্রভাবিত হয়।
আর মেটামডার্নিস্ট কালচারের নিখুঁত নমুনা হইতেছে মিম। যেমন, মুভি থেকে একটা স্ক্রিনশট নিয়া, ক্যাপশন যোগ করে সম্পূর্ণ নতুন মানে সৃষ্টি করা। সৃষ্টির এই এপ্রোচ মেটামডার্নিস্ট এপ্রোচ। গ্রেগ ডেমবার এক প্রবন্ধে মেটামডার্নিজমের ১১টা এপ্রোচের কথা বলছেন। মজার বিষয় ঐ ১১টা এপ্রোচের সবগুলাতেই মিমরে বসায়ে দিলে হুবহু মিলে যায়।
মিমেটিক ছবির একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হইতেছে ফ্রেমের দুই বা ততোধিক উপাদানের মধ্যকার বা টেক্সট ও ইমেজের মধ্যকার অসামঞ্জস্য। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আমরা প্রায়শ দেখি কোনো ব্যক্তি বা বস্তু সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না, ‘যায় না’, অদ্ভুত লাগে। যেহেতু মিমেটিক ছবি প্রসঙ্গের বাইরের (আউট অব কন্টেক্স) বিষয়ের সঙ্গে পাশাপাশি বসে (জাক্সটাপৌজ), অন্যান্য প্রেক্ষিতে তাদের পুনরায় ব্যবহারকে মোটামুটি স্বাভাবিক লাগে। তাছাড়া ফ্রেমে অরিজিনাল মিমেটিক ইমেজের তীব্র ভিন্নতর সহাবস্থানের পাশাপাশি মনে হয় ফটোশপড, রিপার্পাসড। ফলে আরও নতুন নতুন রাস্তা খুলে দেয় আর অরিজিনাল মিমেটিক ফটোর অসামঞ্জস্যতাকে আরও হাস্যকর রকম অসামাঞ্জস্যপূর্ণ করে ফেলা হয়। নমুনা হিসাবে বিখ্যাত ‘ডিজাস্টার গার্ল’ মিমের কথাই ভাবেন। সে খালি ঘরেই আগুন লাগায় নাই, বরং টুইন টাওয়ারে হামলারও মাস্টারমাইন্ড সে!

ইন্টারনেট মিমের অন্য দুইটা মূল প্রবণতা হইতেছে— সৃজনশীল পুনরুৎপাদন ও ইন্টারটেক্সটুয়ালিটি।
সৃজনশীল পুনরুৎপাদন মানে বোঝায় মিমের প্যারডি আর নকলের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠা, যা ঘটতে পারে মিমিক্রি বা রিমিক্সের মাধ্যমে। অন্যদিকে, ইন্টারটেক্সুয়ালিটি বলতে বিষয় বা কালচারের বিভিন্ন অসামঞ্জস্যপূর্ণ দিক ও প্রেক্ষিতবিন্দু পাশাপাশি থাকা। যেমন, ‘শীতের সোদন’খ্যাত শামসুল ইসলামের মিমটা দেখেন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ছবিটা শীতকালের জাতীয় ছবি হয়ে উঠছে। অরিজিনাল ভাইরাল ছবির সঙ্গে কালো চশমা যুক্ত হইছে, ঠোটে জয়েন্ট ধরায়ে এক ধরণের থাগলাইফ-সুলভ ‘কুল’ ভাব এনে দিছে। এর সঙ্গেই আবার Winter Is Here কথাটা যুক্ত হয়ে এনে দিছে গেইম অভ থ্রোনজ এর রেফারেন্সের ব্যাঞ্জনা।
মিমের আয়ু বড়জোর কয়েক ঘন্টা!
তুর্কি কবি নাজিম হিকমত লিখছিলেন, প্রেমের আয়ু বড়জোর এক বছর। একই ভঙ্গিতে বলা যায়, মিমের আয়ু বড়জোর কয়েক ঘন্টা। পুঁজিবাদের ত্বরিত গতির দুনিয়ায় যেকোনো ট্রেন্ডের ক্ষেত্রে যা সত্য, মিমও স্বল্পায়ু। প্রতিটি আলোচিত ঘটনা এখন অজস্র মিমের জন্ম দেয়। আপাতভাবে এইসব মিমের মৃত্যুও হয় খুব দ্রুত। সফলতম মিমগুলারও আয়ু বড়জোর কয়েক মাস। বেশিরভাগ মিম এক সপ্তাহ টিকলেই সেটা অনেক বড় ঘটনা। অধিকাংশ মিম বানানো হয় তাৎক্ষণিকতার বিবেচনায়। বিভিন্ন ও বিচিত্রভাবে বদলে নেওয়ার সুযোগ যত বেশি মিমে থাকে, সেই মিমের আয়ুষ্কাল বেশি হওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়ে।
মিমের আয়ুষ্কালের প্রধান নির্ধারণী ভূমিকা রাখে তার সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা। সংস্কৃতি টুকরা এবং সাংস্কৃতিক রেফারেন্সের বাইরে মিম অর্থবহ হইতে পারে না। আগেভাবে বলে দেওয়া যদিও কঠিন, ভাইরাল হয়া যাওয়ার পরে, কোনো মিম কেনো দর্শক-শ্রোতাদেরকে স্পর্শ করতে পারলো বা জনপ্রিয় হতে পারলো তা বোঝা কঠিন নয়। বিরাজমান সাংস্কৃতিক বাস্তবতারে, ও তার সত্যিগুলোরে স্পর্শ করলে তার আয়ুষ্কাল বেশি হওয়া সম্ভাবনা বাড়ে।
এই ব্যাখ্যা কিন্তু আমাদেরকে অদ্ভুত এক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়ঃ ‘ব্যাড টেক্সটস মেইক গুড মিমস’। অংশগ্রহণমূলক কালচারের নিয়ম যেহেতু ইউজারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, অসম্পূর্ণতা বরং পরবর্তী আরও বাহাসের হুক হিসেবে কাজ করে আর মিমের ছড়িয়ে পড়ায় ভূমিকা রাখে। এ কারণে দেখবেন অসম্পূর্ণ, অমার্জিত, আনাড়ি-সুলভ, এবং উইয়ার্ড টেক্সট, ইমেজ বা ভিডিও মানুষরে যেন শূন্যস্থান পূরণ করতে কিংবা ধাঁধার সমাধান বা ক্রিয়েটরকে মক করতে আমন্ত্রণ জানায়। এই আলাপ ‘শূন্যস্থান হিসেবে কন্টেন্টের ছড়িয়ে পড়া বা বিস্তারযোগ্যতা’ নামে হেনরি জেনকিন্স ও তার সহকর্মীদের দেওয়া তত্ত্বের সাথে মেলে।

জন ফিস্কের ‘প্রোডিউসারলি টেক্সট’- কথাটার মূল আইডিয়াও একই। মিডিয়া প্রোডাক্ট এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে অসামঞ্জস্যের শুন্যতা পূরণ করতে আমন্ত্রণ জানায়, এবং দর্শক-শ্রোতা নিজেরা যেন সেই শুন্যতা পূরণ করে, ফলে অর্থবহ হয়ে ওঠে।
মিম ও পপুলার কালচার
মিডিয়া তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহানের বিখ্যাত উক্তি ‘মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ’। অর্থাৎ বিষয়বস্তু অনেকাংশেই প্রভাবিত হয় সেটি কোন এবং কেমন মিডিয়ামে হাজির হয় তার প্রযুক্তিগত শর্তসমূহ দিয়া। কাঠামোর দিক দিয়া ইন্টারনেট অন্য সকল মিডিয়ার—- টিভি, রেডিও, খবরের কাগজের— চেয়ে আলাদা। অন্য মিডিয়াতে তথ্যের একমুখী প্রবাহ ঘটে। এইসব মিডিয়ায় শেয়ার করা আইডিয়া আমজনতার কাছে ছড়ায়ে পড়তো। কী ছড়াবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতো একটা ছোট্ট গ্রুপ— সম্পাদকীয় বোর্ড, মালিকপক্ষ বা ছোট এলিট। কিন্তু ইন্টারনেটে তথ্য প্রবাহের এই নিয়ন্ত্রণ কোনো এলিট গোষ্ঠীর হাতে নাই। ইন্টারনেট ও ইন্টারনেট মিমের মতো বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রাউড।
জনগনের একটা বড় অংশ কোন জিনিসটা ফানি, ইন্ট্রেস্টিং বা বিরক্তিকর মনে করেছে— তার একটা রোডম্যাপ পাওয়া যায় মিমের ডেটাবেজে। এই দিক দিয়া know your meme কিংবা বাংলায় memelate ধরণের সাইট এই বিবেচনায়, টাইম ক্যাপসুলের কাজ করে। ভবিষ্যত প্রজন্ম যদি দেখতে পারে যে ২০২৪ সালে কী কী বিষয় ভাইরাল হইছিলো—আমরা কেমন ছিলাম সে ব্যাপারে তাদের স্পষ্টতর ধারণা হবে। ইন্টারনেট কালচারের মানচিত্রও বলা যায় মিমরে।
মানুষের আচরণ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে মিম। যতক্ষণে মিম একটা বড় অডিয়েন্সের কাছে পৌছায়, ততক্ষণে শত শত পুনঃপ্রেক্ষিতকরণের (রিকন্টেক্সটচুয়ালাইজেশন) ভেতর দিয়ে গেছে। অরিজিনাল ইমেজ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ট্যাগলাইন ও প্রেক্ষিত থেকে নতুন মিম বানায়, স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান যেমন পুরনো জোকরে নতুন প্রেক্ষিতে হাজির করে। আর যে ভার্শনটা ভাইরাল হয় সেইটা প্রকাশ করে আমাদের ঠিক কোন জিনিসটা স্পর্শ করে।
ইন্টারনেট মিমে পপ কালচারের ভূমিকা বুঝতে, আমাদেরকে প্রথমে বোঝা দরকার, মিমে সমকালীন পপুলার কালচারের প্রতিফলনই মূলত ঘটে। ফলে এর মধ্যে সামাজিক প্রথা, যৌথ অভিজ্ঞতা ও ক্রমপরিবর্তনশীল ট্রেন্ড চলে আসে। অধিকাংশ ইন্টারনেট মিমের উৎপত্তি পপুলার কালচারে। ক্লাসিক মুভি, টিভি সিরিজ, মিউজিক এমনকি রাজনৈতিক ঘটনাও মিম সৃষ্টির মূল হিসেবে কাজ করতে পারে। পপুলার কালচারের আইকনিক ক্যারেক্টার, চলতি বুলি, ও স্মরনীয় মুহূর্ত ইন্টারনেট মিমে নতুন জীবন পায়। একটা উদাহরণ ‘ডিস্ট্র্যাকটেড বয়ফ্রেন্ড’ মিম এ দেখা যায় এক পুরুষ অন্য নারীর দিকে তাকাচ্ছে, আর পাশেই তার প্রেমিকা সেটে দেখে রেগে আছে। ইউজাররা এই ইমেজটা আদি প্রেক্ষিতের বাইরেও অজস্র প্রেক্ষিতে ব্যবহার করে। ফলে মিমের ভাইরাল টেমপ্লেট হয়ে উঠেছে।
মানুষ রিলেট করতে পারে বা যারে ঘিরে তারা বন্ধন তৈরি করতে পারে—এমন যৌথ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পপ কালচার।
মিম এই যৌথ অভিজ্ঞতাকে স্পর্শ করে এবং এক ধরণের আত্মীয়তার বোধ জাগায়। একটা প্রিয় মুভি হোক, বিখ্যাত মিউজিশিয়ান বা রিয়ালিটি শো’র মুহূর্ত হোক, মিম যৌথ সংস্কৃতির এই স্পর্শবিন্দুকে স্পর্শ করে মানুষকে একত্র করে। মিম কেবল পপ কালচারের প্রডাক্ট নয়; মিম সেই কালচারের ক্রিটিক ও ভাষ্য রচনার হাতিয়ারও। ট্রেন্ড, সেলেব্রিটি বা সামাজিক ইস্যুতে স্যাটায়ারিকাল ও ক্রিটিকাল পার্স্পেক্টি হাজির করে। বিজ্ঞাপনের এবসার্ডিটি বা সেলেব্রিটি স্ক্যান্ডাল নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে মিম একটা পরিসর হাজির করে যেখানে আইরনি ও হিউমারের মাধ্যমে কালচারাল ও পলিটিকাল ডিস্কোর্সে অংশ নিতে পারে।
মিমের দ্রুত চেহারা বদল
ইন্টারনেট মিমে পপ কালচারের প্রভাব ডাইনামিক ও ক্রম-বিবর্তনশীল। পপ কালচাররে নতুন ঘটনা অনুযায়ী মিমও এ্যাডাপ্ট করে নেয়। কোনো নতুন স্ট্রিমিং সিরিজ, রাজনৈতিক ঘটনা, ক্যাচি টিউন জনপ্রিয়তা পাইলে, ইন্টারনেট দ্রুত এইসব সাংস্কৃতিক মুহূর্তকে মজাদার ও রিলেটেবল মিমে রূপান্তরিত করে।
পপ কালচার আর মিম কালচার বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে না। একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই সাংস্কৃতিক চক্র সৃষ্টির মাধ্যমে কাজ করে। মিম পপুলার কালচার থেকে যেমন প্রেরণা নেয়, অন্যদিকে পপ কালচারের বিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। মিম পুরনো মিডিয়ায় আগ্রহ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ক্লাসিক ফিল্ম বা মিউজিকরে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারে, এবং অবশ্যই ব্র্যান্ড ও সেলেব্রিটিদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
মিমের ভবিষ্যৎ
ভবিষ্যত সম্পর্কে বলা কঠিন। ভবিষ্যত নিয়া আসে অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা। এইটা ক্রমশ বিবর্তমান প্রযুক্তি, কালচার, ও সামাজিক গতিশীলতা দিয়া প্রভাবিত হয়। তবে প্রযুক্তির গতিপ্রকৃতি দেখে অদূর ভবিষ্যতের মিমের প্রবণতা সম্পর্কে মোটাদাগে কিছু মন্তব্য করা সম্ভব। যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানের পরে, আমরা এআই জেনারেটেড মিমের আধিক্য ভবিষ্যতে দেখতে পারি। এখন বেশিরভাগ মিমের কন্টেন্ট কোনো নাটক-সিনেমা বা বাস্তবজীবনের ভাইরাল ছবি থেকে করা হয়। কিন্তু এআইএর ফলে অরিজিনাল ইমেজটাই কৃত্রিমভাবে নির্মিত হইতে পারে। মিম বানানোর ক্ষেত্রে, আগামী দিনগুলিতে ডিপফেইক প্রযুক্তির ব্যবহারও নিশ্চয়ই বাড়বে। ফলে বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য আরও কমে আসবে।
বিশাল ফলোয়ারওয়ালা এআই জেনারেটেড ক্যারেক্টারগুলো, যাদেরকে বলা হয় ভার্চুয়াল ইনফ্লুয়েন্সার, মিমরে তাদের কন্টেন্টে নিয়া আসতে পারে। ফলে তৈরি হবে ইন্টারনেট মিমের নতুন ধরণের ভ্যারিয়েশন। ইন্টারনেট বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ ক্রমশ বাড়ানোর ফলে, আমরা হয়তো আরও বেশি বৈচিত্র্যময় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রেফারেন্স মিমে দেখবো; বৈশ্বিক ফিউশন একই মিমের মধ্যে হয়তো দেখা যাবে। আর এর ফলে প্রকৃত বৈশ্বিক মিম কালচারের উত্থান দেখবো। মিম কালচারের ক্রমবর্ধমান জটিল অবস্থা ও সচেতনতার ফলে, আমরা এমন মিমও হয়তো দেখবো যে মিম নিজেই মিম-কালচার ও মিমের প্রকৃতি নিয়া কমেন্ট করবে, চুটকি করবে, বা মিম ট্রেন্ড এনালিসিসও মিমের মধ্যে ঢুকে পড়বে। এরে মেটামিম বলা যাইতে পারে। যত রকম পরিবর্তনই আসুক না কেন, মিম যে বড় একটা সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে থেকে যাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। যতদিন দুনিয়াতে ইমেজের প্রতি নির্ভরতা থাকবে, ভার্চুয়াল ও রিয়ালের মধ্যে ব্যবধান কম থাকবে, ততদিন মিমও আমাদের নিত্যদিনের এক্সপ্রেশনের অন্যতম ফিচার হিসেবে থাকবে।