KM Rakib
কে এম রাকিব
ভাষায় বসতি
বাংলাদেশে শীতকালীন মিমের আইকনিক চরিত্র শামসুল সাহেব। তার 'শীতের সোদনে দাঁড়াতে পারছি না' ডায়লগ দেশে শীতকালীন মিম দুনিয়ার জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়েছে।

আপনার বয়স চল্লিশের বেশি হয়া থাকলে মিম জিনিসটার সাথে পরিচয় থাকাটা বিরল। আর বয়স পঁচিশের কম হইলে পরিচয় না থাকাটাই বরং বিরল অর্থাৎ মিম কী জিনিস ব্যাখ্যা না করলেও চলে। তাছাড়া জোক, স্বপ্ন বা টিনেজ কালচার ব্যাখ্যা করার মতো, মিম ব্যাখ্যা করাও বেশ ‘আনকুল’ ব্যাপার। ব্যাখ্যায় আয়াস লাগে; অথচ যে আর্ট ফর্ম ‘অনায়াস’ দেখাইতে সদা সচেষ্ট তারে ব্যাখ্যা করা আর রামগরুরের ছানা হওয়া একই কথা। তবে রামগরুরের ছানা বা অতিশয় সিরিয়াস হইতে আমার আপত্তি নাই। সিরিয়াস প্রবন্ধ লেখার একটা চালু তরিকা আছে। যেমন: প্রবন্ধের চাবি-শব্দ ধরে কিছুক্ষণ বাতেলা দিতে হবে। কই থেকে শব্দটা আসলো? আদি উৎস থেকে কীভাবে শব্দটার বিবর্তন ঘটছে? অভিধানে একটু ঘোরাফেরা করে এসে হালকা পাণ্ডিত্য জাহির করা আরকি। সেই তরিকা অনুসরণ করা যাক।           

মিম জিনিসটা ইন্টারনেটের বাইরে কল্পনা করা কঠিন অথচ মিমের ধারণা ও মিম শব্দটার বয়স কিন্তু ইন্টারনেটের চাইতেও বেশি! দুনিয়া অবারিত তথ্যের এক সমুদ্র। তথ্য বা আইডিয়া মানুষের জিনের মতো আচরণ করে। আইডিয়া ছড়ায়, আইডিয়া অন্য আইডিয়ার সাথে মিথষ্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়, ফলে বদলায় এবং নতুন নতুন আইডিয়ার জন্ম দেয়। কিভাবে সাংস্কৃতিক তথ্য বৃহত্তর সমাজে ছড়ায়ে পড়ে, আর বদলাইতে থাকে, তা ব্যাখ্যা করতে চাইছিলেন ব্রিটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স। তার মতে, ‘সকল প্রাণীর কেন্দ্রে তপঃ নাই, নিঃশ্বাসের উত্তাপ নাই, জীবনের স্ফূরণও  নাই। মৌল বিষয় হইতেছে তথ্য, শব্দ, নির্দেশনা।’  ডকিন্স আরও বলতেছেন, ‘জীবনরে বুঝতে চাইলে, জীবন্ত, ছটফটানো জেলি ও পিছ্লা ভ্রুণের কথা ভাইবেন না, চিন্তা করেন তথ্যের প্রযুক্তির কথা।’         

যেহেতু কোনো কনসেপ্ট— একটা আইডিয়া, স্টাইল বা যেকোনো ধরণের আচরণ— যা কোনো সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে; যেহেতু প্রক্রিয়াটা মানুষের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য ট্রান্সমিশনের মতই, ডকিন্স একাক্ষরের একটা শব্দ খুজতেছিলেন যা জিন -এর সাথে অন্তমিল রাখে। এক পর্যায়ে  তিনি গ্রিক শব্দ mimeme (যা অনুসৃত হয়) খুজে পান আর তার বিখ্যাত বই সেলফিশ জিন-(১৯৭৬) এ রিচার্ড ডকিন্স ‘মৌল’ এই বিষয়টার নাম ডকিন্স দিছেন, mimeme। কথাটারই সংক্ষিপ্ত রূপ তথা meme (আমার অনুমান ‘সেলফিশ জিন’ বা ‘রিলিজিওসিটি’ ধরণের নামকরনের চাইতে ভবিষ্যতের মানুষ ডকিন্সরে মনে রাখবে মূলত ‘মিম’ শব্দটার উদ্ভাবক হিসেবেই)। পরে মাইক গডউইন ১৯৯৩ সালে মেসেজবোর্ড, ইউজারনেট বা ইমেইলে ছড়ানো মিম ব্যাখ্যা করতে গিয়া ইন্টারনেট মিম কথাটা চালু করেন।  

এই লেখায় কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমরা বিস্তারিত জানা-বোঝার চেষ্টা করবো।
মিম কিভাবে কাজ করে?
মিমের স্বভাব-চরিত্রই বা কেমন? 
মিমের সামাজিক প্রভাব—বিশেষত পপুলার কালচারে—কীরকম?
জোকের সাথে মিমের মিল-অমিল থাকলে সেগুলো কেমন?
অনাগত দিনগুলিতে মিমের স্বভাব-চরিত্রের গতিপথ কোন দিকে যাইতে পারে?

আসেন, শুরু করি।    

মিম কী? 
মিমের একখানা সংজ্ঞা একান্ত দিতে হইলে এইভাবে বলা যায়: মিম, মোটাদাগে, দৃশ্য মাধ্যমের এক ধরণের ইনসাইড জোক। চিকনদাগে আরও অনেক কিছু, তবে মোটাদাগের সংজ্ঞাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে। তো, আর্টফর্ম হিসেবে ইন্টারনেট মিম মূলত ভিজুয়াল জোক বা দৃশ্য মাধ্যমের কৌতুক। আর ভিডিও মিম হইতেছে অডিও-ভিজুয়াল জোক। এইভাবে দেখলে মিমের সোশ্যাল বা রাজনৈতিক মাত্রা ও পরিণাম শনাক্ত করা সহজ। জোকে, যেমন– ১টা প্রেক্ষিতবিন্দুর (রেফারেন্স পয়েন্ট) সাথে আরেকটা প্রেক্ষিতবিন্দু জাক্সটাপোজ করা বা একসঙ্গে বসানো হয়, মিমেও সেইটা হয়। ২টা ভিন্ন প্রেক্ষিতের তাৎক্ষণিক বা অভাবনীয় মিলন মজাটা তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন প্রসঙ্গে বলছেন কিন্তু হাস্যরস মৌলপ্রবণতা সম্পর্কে তার অনুমানও কাছাকাছি:  ‘হাস্যরসের প্রধান দুইটি উপাদান অবাধ দ্রুতবেগ ও অভাবনীয়তা’ (রবীন্দ্রনাথ: ছন্দ | বাংলা ছন্দে অনুপ্রাস)। এই অভাবনীয়তা প্রেক্ষিতগত সার্প্রাইজ বা চমক থেকে তৈরি হয়। মিমের সাথে জোকের তফাৎ হইতেছে মিমে টেক্সটের পাশাপাশি ইমেজ বা (ভিডিও মিমের ক্ষেত্রে) মুভিং ইমেজ যুক্ত হয়ে বৈচিত্র্য ও পরিসর আরও বাড়ায়ে দেয়।  

জোকের যে পলিটিক্স বা সামাজিক পরিণাম থাকে মিমের ক্ষেত্রেও তেমনই থাকে। মিমের ক্ষেত্রে, বিষয়টা—এহেম —মিমেটিক অর্থাৎ সাধারণ জোকের চেয়ে লোকের মধ্যে ছড়ায়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এ কারণে ভাইরাল বা পপুলার ইমেজের মিমেটিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু শেষপর্যন্ত মিম জোকই—পুনরাবৃত্তিযোগ্য এবং পুনরায় নির্মাণযোগ্য জোক। এ কারণেই মিম একটা হাইব্রিড মিডিয়াম— যেখানে সাধারণত ২টা মিডিয়াম (টেক্সট ও ইমেজ/মুভিং ইমেজ) একত্রে হাস্যরস সৃষ্টি করে। মিমে ভিজুয়াল বা ইমেজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, টেক্সটের চাইতে। কেন?  কারণ, আপনি টেক্সট ছাড়াও মিম বানাইতে পারবেন কিন্তু ইমেজ ছাড়া খালি টেক্সট দিয়া মিম বানাইতে পারবেন না; সেইটা লিখিত জোক হবে।   

জোকের সাথে মিমের মাত্রাগত ভিন্নতাও আছে দৃশ্য মাধ্যমের বইলা টেক্সটের চাইতে মিমে স্বাভাবিক নমনীয়তা বেশি। অবশ্য জোকের বা মিমের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনা যেমন আছে, ডমিন্যান্ট মতাদর্শের পলিটিক্সের বাহন হওয়াও আছে (জোকের বড় একটা অংশ মূলত শ্রেণিবিদ্বেষ ধারণ করে)।   

মজার কোনো ইমেজে উইটি ক্যাপশন থেকে ভাইরাল চ্যালেঞ্জ, চলতি বুলি (ক্যাচফ্রেজ) এমনকি নাচও মিম হইতে পারে। ইন্ডিয়ার সোহম ও মিমি চক্রবর্তী অভিনিত ‘বোঝে না সে বোঝে না’ (২০১২) মুভির ‘নারে নাহ, নারে না ’ নামে একটা হিট গানে নির্দিষ্ট ঢংয়ে নাচের ভঙ্গিটাও আসলে একটা মিম। একইভাবে ইউটিউবের প্রথম গ্লোবাল হিট সং সাই-এর গ্যাংনাম স্টাইল-এর ড্যান্স মুভও মিম। মোদ্দাকথা, সাংস্কৃতিক পরিসরে যার ব্যাপক পুনরুৎপাদন ও পুনর্নিমাণ ঘটে, তারেই মিম বলা যায়।   

মিমের স্বভাব-চরিত্র  

একের সাথে অন্যের মিলমিশের, প্রত্যয়গত (কনসেপ্টুয়াল) ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে এমনকি বিপরীত প্রেক্ষিতের আইডিয়ার মিশেল অর্থাৎ নানান অদ্ভুতুড়ে রিমিক্সিং মিম কালচারের মূল বৈশিষ্ট্য। কালচারে মোটাদাগে এই প্রবণতারে অনেক ক্রিটিক বলেন ‘মেটামডার্নিজম’। মানে হইতেছে মডার্ন সিরিয়াসনেসের সঙ্গে পোস্টমডার্ন আইরনি বা পরিহাসময়তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া। ফলস্বরূপ আশা ও নিরাশা, এমপ্যাথি ও এপ্যাথি, একত্ব ও  বহুত্বের পরিষ্কার অবস্থান দেখা যায় না, চলতে শুরু করে অবিরাম ভাব ও ব্যাঞ্জনাগত দোলাচাল। ইন্টারনেটের দুনিয়া কালচারের এই মেটামডার্ন সেন্সিবিলিটি দিয়া ব্যাপকমাত্রায় প্রভাবিত হয়।              

আর মেটামডার্নিস্ট কালচারের নিখুঁত নমুনা হইতেছে মিম। যেমন, মুভি থেকে একটা স্ক্রিনশট নিয়া, ক্যাপশন যোগ করে সম্পূর্ণ নতুন মানে সৃষ্টি করা। সৃষ্টির এই এপ্রোচ মেটামডার্নিস্ট এপ্রোচ। গ্রেগ ডেমবার এক প্রবন্ধে মেটামডার্নিজমের ১১টা এপ্রোচের কথা বলছেন। মজার বিষয় ঐ ১১টা এপ্রোচের সবগুলাতেই মিমরে বসায়ে দিলে হুবহু মিলে যায়।     

মিমেটিক ছবির একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হইতেছে ফ্রেমের দুই বা ততোধিক উপাদানের মধ্যকার বা টেক্সট ও ইমেজের মধ্যকার অসামঞ্জস্য। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আমরা প্রায়শ দেখি কোনো ব্যক্তি বা বস্তু সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না, ‘যায় না’, অদ্ভুত লাগে। যেহেতু  মিমেটিক ছবি প্রসঙ্গের বাইরের (আউট অব কন্টেক্স) বিষয়ের সঙ্গে পাশাপাশি বসে (জাক্সটাপৌজ), অন্যান্য প্রেক্ষিতে তাদের পুনরায় ব্যবহারকে মোটামুটি স্বাভাবিক লাগে। তাছাড়া ফ্রেমে অরিজিনাল মিমেটিক ইমেজের তীব্র ভিন্নতর সহাবস্থানের পাশাপাশি মনে হয় ফটোশপড, রিপার্পাসড। ফলে আরও নতুন নতুন রাস্তা খুলে দেয় আর অরিজিনাল মিমেটিক ফটোর অসামঞ্জস্যতাকে আরও হাস্যকর রকম অসামাঞ্জস্যপূর্ণ করে ফেলা হয়। নমুনা হিসাবে বিখ্যাত ‘ডিজাস্টার গার্ল’ মিমের কথাই ভাবেন। সে খালি ঘরেই আগুন লাগায় নাই, বরং টুইন টাওয়ারে হামলারও মাস্টারমাইন্ড সে!    

ডিজাস্টার গার্ল, যাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য মিম

ইন্টারনেট মিমের অন্য দুইটা মূল প্রবণতা হইতেছে— সৃজনশীল পুনরুৎপাদন ও ইন্টারটেক্সটুয়ালিটি।  

সৃজনশীল পুনরুৎপাদন মানে বোঝায় মিমের প্যারডি আর নকলের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠা, যা ঘটতে পারে মিমিক্রি বা রিমিক্সের মাধ্যমে। অন্যদিকে, ইন্টারটেক্সুয়ালিটি বলতে বিষয় বা কালচারের বিভিন্ন অসামঞ্জস্যপূর্ণ দিক ও প্রেক্ষিতবিন্দু পাশাপাশি থাকা। যেমন, ‘শীতের সোদন’খ্যাত শামসুল ইসলামের মিমটা দেখেন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ছবিটা শীতকালের জাতীয় ছবি হয়ে উঠছে। অরিজিনাল ভাইরাল ছবির সঙ্গে কালো চশমা যুক্ত হইছে, ঠোটে জয়েন্ট ধরায়ে এক ধরণের থাগলাইফ-সুলভ ‘কুল’ ভাব এনে দিছে। এর সঙ্গেই আবার Winter Is Here কথাটা যুক্ত হয়ে এনে দিছে গেইম অভ থ্রোনজ এর রেফারেন্সের ব্যাঞ্জনা।            

মিমের আয়ু বড়জোর কয়েক ঘন্টা! 
তুর্কি কবি নাজিম হিকমত লিখছিলেন, প্রেমের আয়ু বড়জোর এক বছর। একই ভঙ্গিতে বলা যায়, মিমের আয়ু বড়জোর কয়েক ঘন্টা। পুঁজিবাদের ত্বরিত গতির দুনিয়ায় যেকোনো ট্রেন্ডের ক্ষেত্রে যা সত্য, মিমও স্বল্পায়ু। প্রতিটি আলোচিত ঘটনা এখন অজস্র মিমের জন্ম দেয়। আপাতভাবে এইসব মিমের মৃত্যুও হয় খুব দ্রুত। সফলতম মিমগুলারও আয়ু বড়জোর কয়েক মাস। বেশিরভাগ মিম এক সপ্তাহ টিকলেই সেটা অনেক বড় ঘটনা। অধিকাংশ মিম বানানো হয় তাৎক্ষণিকতার বিবেচনায়। বিভিন্ন ও বিচিত্রভাবে বদলে নেওয়ার সুযোগ যত বেশি মিমে থাকে, সেই মিমের আয়ুষ্কাল বেশি হওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়ে।        

মিমের আয়ুষ্কালের প্রধান নির্ধারণী ভূমিকা রাখে তার সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা। সংস্কৃতি টুকরা এবং সাংস্কৃতিক রেফারেন্সের বাইরে মিম অর্থবহ হইতে পারে না। আগেভাবে বলে দেওয়া যদিও কঠিন, ভাইরাল হয়া যাওয়ার পরে, কোনো মিম কেনো দর্শক-শ্রোতাদেরকে স্পর্শ করতে পারলো বা জনপ্রিয় হতে পারলো তা বোঝা কঠিন নয়। বিরাজমান সাংস্কৃতিক বাস্তবতারে, ও তার সত্যিগুলোরে স্পর্শ করলে তার আয়ুষ্কাল বেশি হওয়া সম্ভাবনা বাড়ে।               
এই ব্যাখ্যা কিন্তু আমাদেরকে অদ্ভুত এক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়ঃ ‘ব্যাড টেক্সটস মেইক গুড মিমস’। অংশগ্রহণমূলক কালচারের নিয়ম যেহেতু ইউজারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, অসম্পূর্ণতা বরং পরবর্তী আরও বাহাসের হুক হিসেবে কাজ করে আর মিমের ছড়িয়ে পড়ায় ভূমিকা রাখে। এ কারণে দেখবেন অসম্পূর্ণ, অমার্জিত, আনাড়ি-সুলভ, এবং উইয়ার্ড টেক্সট, ইমেজ বা ভিডিও মানুষরে যেন শূন্যস্থান পূরণ করতে কিংবা ধাঁধার সমাধান বা ক্রিয়েটরকে মক করতে আমন্ত্রণ জানায়। এই আলাপ ‘শূন্যস্থান হিসেবে কন্টেন্টের ছড়িয়ে পড়া বা বিস্তারযোগ্যতা’ নামে হেনরি জেনকিন্স ও তার সহকর্মীদের দেওয়া তত্ত্বের সাথে মেলে।     

স্প্রেডেবল মিডিয়াঃ ক্রিয়েটিং ভ্যালু এন্ড মিনিং ইন আ নেটওয়ার্কড কালচার বইয়ের প্রচ্ছদ

জন ফিস্কের ‘প্রোডিউসারলি টেক্সট’- কথাটার মূল আইডিয়াও একই। মিডিয়া প্রোডাক্ট এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে অসামঞ্জস্যের শুন্যতা পূরণ করতে আমন্ত্রণ জানায়, এবং দর্শক-শ্রোতা নিজেরা যেন সেই শুন্যতা পূরণ করে, ফলে অর্থবহ হয়ে ওঠে।       

মিম ও পপুলার কালচার  

মিডিয়া তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহানের বিখ্যাত উক্তি ‘মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ’। অর্থাৎ বিষয়বস্তু অনেকাংশেই প্রভাবিত হয় সেটি কোন এবং কেমন মিডিয়ামে হাজির হয় তার প্রযুক্তিগত শর্তসমূহ দিয়া। কাঠামোর দিক দিয়া ইন্টারনেট অন্য সকল মিডিয়ার—- টিভি, রেডিও, খবরের কাগজের— চেয়ে আলাদা।  অন্য মিডিয়াতে তথ্যের একমুখী প্রবাহ ঘটে। এইসব মিডিয়ায় শেয়ার করা আইডিয়া আমজনতার কাছে ছড়ায়ে পড়তো। কী ছড়াবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতো একটা ছোট্ট গ্রুপ— সম্পাদকীয় বোর্ড, মালিকপক্ষ বা ছোট এলিট। কিন্তু ইন্টারনেটে তথ্য প্রবাহের এই নিয়ন্ত্রণ কোনো এলিট গোষ্ঠীর হাতে নাই। ইন্টারনেট ও ইন্টারনেট মিমের মতো বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রাউড। 

জনগনের একটা বড় অংশ কোন জিনিসটা ফানি, ইন্ট্রেস্টিং বা বিরক্তিকর মনে করেছে— তার একটা রোডম্যাপ পাওয়া যায় মিমের ডেটাবেজে। এই দিক দিয়া know your meme কিংবা বাংলায় memelate ধরণের সাইট এই বিবেচনায়,  টাইম ক্যাপসুলের কাজ করে। ভবিষ্যত প্রজন্ম যদি দেখতে পারে যে ২০২৪ সালে কী কী বিষয় ভাইরাল হইছিলো—আমরা কেমন ছিলাম সে ব্যাপারে তাদের স্পষ্টতর ধারণা হবে।  ইন্টারনেট কালচারের মানচিত্রও বলা যায় মিমরে।  

মানুষের আচরণ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে মিম।  যতক্ষণে মিম একটা বড় অডিয়েন্সের কাছে পৌছায়, ততক্ষণে শত শত পুনঃপ্রেক্ষিতকরণের (রিকন্টেক্সটচুয়ালাইজেশন) ভেতর দিয়ে গেছে। অরিজিনাল ইমেজ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ট্যাগলাইন ও প্রেক্ষিত থেকে নতুন মিম বানায়, স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান যেমন পুরনো জোকরে নতুন প্রেক্ষিতে হাজির করে। আর যে ভার্শনটা ভাইরাল হয় সেইটা প্রকাশ করে আমাদের ঠিক কোন জিনিসটা স্পর্শ করে।  

ইন্টারনেট মিমে পপ কালচারের ভূমিকা বুঝতে, আমাদেরকে প্রথমে বোঝা দরকার, মিমে সমকালীন পপুলার কালচারের প্রতিফলনই মূলত ঘটে। ফলে এর মধ্যে সামাজিক প্রথা, যৌথ অভিজ্ঞতা ও ক্রমপরিবর্তনশীল ট্রেন্ড চলে আসে। অধিকাংশ ইন্টারনেট মিমের উৎপত্তি পপুলার কালচারে। ক্লাসিক মুভি, টিভি সিরিজ, মিউজিক এমনকি রাজনৈতিক ঘটনাও মিম সৃষ্টির মূল হিসেবে কাজ করতে পারে। পপুলার কালচারের আইকনিক ক্যারেক্টার, চলতি বুলি, ও স্মরনীয় মুহূর্ত ইন্টারনেট মিমে নতুন জীবন পায়। একটা উদাহরণ ‘ডিস্ট্র্যাকটেড বয়ফ্রেন্ড’ মিম এ দেখা যায় এক  পুরুষ অন্য নারীর দিকে তাকাচ্ছে, আর পাশেই তার প্রেমিকা সেটে দেখে রেগে আছে। ইউজাররা এই ইমেজটা আদি প্রেক্ষিতের বাইরেও অজস্র প্রেক্ষিতে ব্যবহার করে। ফলে মিমের ভাইরাল টেমপ্লেট হয়ে উঠেছে।  

মানুষ রিলেট করতে পারে বা যারে ঘিরে তারা বন্ধন তৈরি করতে পারে—এমন যৌথ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পপ কালচার।
মিম এই যৌথ অভিজ্ঞতাকে স্পর্শ করে এবং এক ধরণের আত্মীয়তার বোধ জাগায়। একটা প্রিয় মুভি হোক, বিখ্যাত মিউজিশিয়ান বা রিয়ালিটি শো’র মুহূর্ত হোক, মিম যৌথ সংস্কৃতির এই স্পর্শবিন্দুকে স্পর্শ করে মানুষকে একত্র করে। মিম কেবল পপ কালচারের প্রডাক্ট নয়; মিম সেই কালচারের ক্রিটিক ও ভাষ্য রচনার হাতিয়ারও। ট্রেন্ড, সেলেব্রিটি বা সামাজিক ইস্যুতে স্যাটায়ারিকাল ও ক্রিটিকাল পার্স্পেক্টি হাজির করে। বিজ্ঞাপনের এবসার্ডিটি বা সেলেব্রিটি স্ক্যান্ডাল নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে মিম একটা পরিসর হাজির করে যেখানে আইরনি ও হিউমারের মাধ্যমে কালচারাল ও পলিটিকাল ডিস্কোর্সে অংশ নিতে পারে।      

মিমের দ্রুত চেহারা বদল 

ইন্টারনেট মিমে পপ কালচারের প্রভাব ডাইনামিক ও ক্রম-বিবর্তনশীল। পপ কালচাররে নতুন ঘটনা অনুযায়ী মিমও এ্যাডাপ্ট করে নেয়। কোনো নতুন স্ট্রিমিং সিরিজ, রাজনৈতিক ঘটনা, ক্যাচি টিউন জনপ্রিয়তা পাইলে, ইন্টারনেট দ্রুত এইসব সাংস্কৃতিক মুহূর্তকে মজাদার ও রিলেটেবল মিমে রূপান্তরিত করে।  

পপ কালচার আর মিম কালচার বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে না। একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই সাংস্কৃতিক চক্র সৃষ্টির মাধ্যমে  কাজ করে। মিম পপুলার কালচার থেকে যেমন প্রেরণা নেয়, অন্যদিকে পপ কালচারের বিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। মিম পুরনো মিডিয়ায় আগ্রহ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ক্লাসিক ফিল্ম বা মিউজিকরে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারে, এবং অবশ্যই ব্র্যান্ড ও সেলেব্রিটিদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজিতে ভূমিকা রাখতে পারে।  


মিমের ভবিষ্যৎ  

ভবিষ্যত সম্পর্কে বলা কঠিন। ভবিষ্যত নিয়া আসে অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা। এইটা ক্রমশ বিবর্তমান প্রযুক্তি, কালচার, ও সামাজিক গতিশীলতা দিয়া প্রভাবিত হয়। তবে প্রযুক্তির গতিপ্রকৃতি দেখে অদূর ভবিষ্যতের মিমের প্রবণতা সম্পর্কে মোটাদাগে কিছু মন্তব্য করা সম্ভব। যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানের পরে, আমরা এআই জেনারেটেড মিমের আধিক্য ভবিষ্যতে দেখতে পারি। এখন বেশিরভাগ মিমের কন্টেন্ট কোনো নাটক-সিনেমা বা বাস্তবজীবনের ভাইরাল ছবি থেকে করা হয়। কিন্তু এআইএর ফলে অরিজিনাল ইমেজটাই কৃত্রিমভাবে নির্মিত হইতে পারে। মিম বানানোর ক্ষেত্রে, আগামী দিনগুলিতে ডিপফেইক প্রযুক্তির ব্যবহারও নিশ্চয়ই বাড়বে। ফলে বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য আরও কমে আসবে।   

বিশাল ফলোয়ারওয়ালা এআই জেনারেটেড ক্যারেক্টারগুলো, যাদেরকে বলা হয় ভার্চুয়াল ইনফ্লুয়েন্সার, মিমরে তাদের কন্টেন্টে নিয়া আসতে পারে। ফলে তৈরি হবে ইন্টারনেট মিমের নতুন ধরণের ভ্যারিয়েশন। ইন্টারনেট বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ ক্রমশ বাড়ানোর ফলে, আমরা হয়তো আরও বেশি বৈচিত্র্যময় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রেফারেন্স মিমে দেখবো; বৈশ্বিক ফিউশন একই মিমের মধ্যে হয়তো দেখা যাবে। আর এর ফলে প্রকৃত বৈশ্বিক মিম কালচারের উত্থান দেখবো। মিম কালচারের ক্রমবর্ধমান জটিল অবস্থা ও সচেতনতার ফলে, আমরা এমন মিমও হয়তো দেখবো যে মিম নিজেই মিম-কালচার ও মিমের প্রকৃতি নিয়া কমেন্ট করবে, চুটকি করবে, বা মিম ট্রেন্ড এনালিসিসও মিমের মধ্যে ঢুকে পড়বে। এরে মেটামিম বলা যাইতে পারে। যত রকম পরিবর্তনই আসুক না কেন, মিম যে বড় একটা সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে থেকে যাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। যতদিন দুনিয়াতে ইমেজের প্রতি নির্ভরতা থাকবে, ভার্চুয়াল ও রিয়ালের মধ্যে ব্যবধান কম থাকবে, ততদিন মিমও আমাদের নিত্যদিনের এক্সপ্রেশনের অন্যতম ফিচার হিসেবে থাকবে। 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।