KM Rakib
কে এম রাকিব
ভাষায় বসতি
বাংলাদেশে শীতকালীন মিমের আইকনিক চরিত্র শামসুল সাহেব। তার 'শীতের সোদনে দাঁড়াতে পারছি না' ডায়লগ দেশে শীতকালীন মিম দুনিয়ার জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়েছে।

আপনার বয়স চল্লিশের বেশি হয়া থাকলে মিম জিনিসটার সাথে পরিচয় থাকাটা বিরল। আর বয়স পঁচিশের কম হইলে পরিচয় না থাকাটাই বরং বিরল অর্থাৎ মিম কী জিনিস ব্যাখ্যা না করলেও চলে। তাছাড়া জোক, স্বপ্ন বা টিনেজ কালচার ব্যাখ্যা করার মতো, মিম ব্যাখ্যা করাও বেশ ‘আনকুল’ ব্যাপার। ব্যাখ্যায় আয়াস লাগে; অথচ যে আর্ট ফর্ম ‘অনায়াস’ দেখাইতে সদা সচেষ্ট তারে ব্যাখ্যা করা আর রামগরুরের ছানা হওয়া একই কথা। তবে রামগরুরের ছানা বা অতিশয় সিরিয়াস হইতে আমার আপত্তি নাই। সিরিয়াস প্রবন্ধ লেখার একটা চালু তরিকা আছে। যেমন: প্রবন্ধের চাবি-শব্দ ধরে কিছুক্ষণ বাতেলা দিতে হবে। কই থেকে শব্দটা আসলো? আদি উৎস থেকে কীভাবে শব্দটার বিবর্তন ঘটছে? অভিধানে একটু ঘোরাফেরা করে এসে হালকা পাণ্ডিত্য জাহির করা আরকি। সেই তরিকা অনুসরণ করা যাক।           

মিম জিনিসটা ইন্টারনেটের বাইরে কল্পনা করা কঠিন অথচ মিমের ধারণা ও মিম শব্দটার বয়স কিন্তু ইন্টারনেটের চাইতেও বেশি! দুনিয়া অবারিত তথ্যের এক সমুদ্র। তথ্য বা আইডিয়া মানুষের জিনের মতো আচরণ করে। আইডিয়া ছড়ায়, আইডিয়া অন্য আইডিয়ার সাথে মিথষ্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়, ফলে বদলায় এবং নতুন নতুন আইডিয়ার জন্ম দেয়। কিভাবে সাংস্কৃতিক তথ্য বৃহত্তর সমাজে ছড়ায়ে পড়ে, আর বদলাইতে থাকে, তা ব্যাখ্যা করতে চাইছিলেন ব্রিটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স। তার মতে, ‘সকল প্রাণীর কেন্দ্রে তপঃ নাই, নিঃশ্বাসের উত্তাপ নাই, জীবনের স্ফূরণও  নাই। মৌল বিষয় হইতেছে তথ্য, শব্দ, নির্দেশনা।’  ডকিন্স আরও বলতেছেন, ‘জীবনরে বুঝতে চাইলে, জীবন্ত, ছটফটানো জেলি ও পিছ্লা ভ্রুণের কথা ভাইবেন না, চিন্তা করেন তথ্যের প্রযুক্তির কথা।’         

যেহেতু কোনো কনসেপ্ট— একটা আইডিয়া, স্টাইল বা যেকোনো ধরণের আচরণ— যা কোনো সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে; যেহেতু প্রক্রিয়াটা মানুষের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য ট্রান্সমিশনের মতই, ডকিন্স একাক্ষরের একটা শব্দ খুজতেছিলেন যা জিন -এর সাথে অন্তমিল রাখে। এক পর্যায়ে  তিনি গ্রিক শব্দ mimeme (যা অনুসৃত হয়) খুজে পান আর তার বিখ্যাত বই সেলফিশ জিন-(১৯৭৬) এ রিচার্ড ডকিন্স ‘মৌল’ এই বিষয়টার নাম ডকিন্স দিছেন, mimeme। কথাটারই সংক্ষিপ্ত রূপ তথা meme (আমার অনুমান ‘সেলফিশ জিন’ বা ‘রিলিজিওসিটি’ ধরণের নামকরনের চাইতে ভবিষ্যতের মানুষ ডকিন্সরে মনে রাখবে মূলত ‘মিম’ শব্দটার উদ্ভাবক হিসেবেই)। পরে মাইক গডউইন ১৯৯৩ সালে মেসেজবোর্ড, ইউজারনেট বা ইমেইলে ছড়ানো মিম ব্যাখ্যা করতে গিয়া ইন্টারনেট মিম কথাটা চালু করেন।  

এই লেখায় কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমরা বিস্তারিত জানা-বোঝার চেষ্টা করবো।
মিম কিভাবে কাজ করে?
মিমের স্বভাব-চরিত্রই বা কেমন? 
মিমের সামাজিক প্রভাব—বিশেষত পপুলার কালচারে—কীরকম?
জোকের সাথে মিমের মিল-অমিল থাকলে সেগুলো কেমন?
অনাগত দিনগুলিতে মিমের স্বভাব-চরিত্রের গতিপথ কোন দিকে যাইতে পারে?

আসেন, শুরু করি।    

মিম কী? 
মিমের একখানা সংজ্ঞা একান্ত দিতে হইলে এইভাবে বলা যায়: মিম, মোটাদাগে, দৃশ্য মাধ্যমের এক ধরণের ইনসাইড জোক। চিকনদাগে আরও অনেক কিছু, তবে মোটাদাগের সংজ্ঞাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে। তো, আর্টফর্ম হিসেবে ইন্টারনেট মিম মূলত ভিজুয়াল জোক বা দৃশ্য মাধ্যমের কৌতুক। আর ভিডিও মিম হইতেছে অডিও-ভিজুয়াল জোক। এইভাবে দেখলে মিমের সোশ্যাল বা রাজনৈতিক মাত্রা ও পরিণাম শনাক্ত করা সহজ। জোকে, যেমন– ১টা প্রেক্ষিতবিন্দুর (রেফারেন্স পয়েন্ট) সাথে আরেকটা প্রেক্ষিতবিন্দু জাক্সটাপোজ করা বা একসঙ্গে বসানো হয়, মিমেও সেইটা হয়। ২টা ভিন্ন প্রেক্ষিতের তাৎক্ষণিক বা অভাবনীয় মিলন মজাটা তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন প্রসঙ্গে বলছেন কিন্তু হাস্যরস মৌলপ্রবণতা সম্পর্কে তার অনুমানও কাছাকাছি:  ‘হাস্যরসের প্রধান দুইটি উপাদান অবাধ দ্রুতবেগ ও অভাবনীয়তা’ (রবীন্দ্রনাথ: ছন্দ | বাংলা ছন্দে অনুপ্রাস)। এই অভাবনীয়তা প্রেক্ষিতগত সার্প্রাইজ বা চমক থেকে তৈরি হয়। মিমের সাথে জোকের তফাৎ হইতেছে মিমে টেক্সটের পাশাপাশি ইমেজ বা (ভিডিও মিমের ক্ষেত্রে) মুভিং ইমেজ যুক্ত হয়ে বৈচিত্র্য ও পরিসর আরও বাড়ায়ে দেয়।  

জোকের যে পলিটিক্স বা সামাজিক পরিণাম থাকে মিমের ক্ষেত্রেও তেমনই থাকে। মিমের ক্ষেত্রে, বিষয়টা—এহেম —মিমেটিক অর্থাৎ সাধারণ জোকের চেয়ে লোকের মধ্যে ছড়ায়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এ কারণে ভাইরাল বা পপুলার ইমেজের মিমেটিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু শেষপর্যন্ত মিম জোকই—পুনরাবৃত্তিযোগ্য এবং পুনরায় নির্মাণযোগ্য জোক। এ কারণেই মিম একটা হাইব্রিড মিডিয়াম— যেখানে সাধারণত ২টা মিডিয়াম (টেক্সট ও ইমেজ/মুভিং ইমেজ) একত্রে হাস্যরস সৃষ্টি করে। মিমে ভিজুয়াল বা ইমেজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, টেক্সটের চাইতে। কেন?  কারণ, আপনি টেক্সট ছাড়াও মিম বানাইতে পারবেন কিন্তু ইমেজ ছাড়া খালি টেক্সট দিয়া মিম বানাইতে পারবেন না; সেইটা লিখিত জোক হবে।   

জোকের সাথে মিমের মাত্রাগত ভিন্নতাও আছে দৃশ্য মাধ্যমের বইলা টেক্সটের চাইতে মিমে স্বাভাবিক নমনীয়তা বেশি। অবশ্য জোকের বা মিমের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনা যেমন আছে, ডমিন্যান্ট মতাদর্শের পলিটিক্সের বাহন হওয়াও আছে (জোকের বড় একটা অংশ মূলত শ্রেণিবিদ্বেষ ধারণ করে)।   

মজার কোনো ইমেজে উইটি ক্যাপশন থেকে ভাইরাল চ্যালেঞ্জ, চলতি বুলি (ক্যাচফ্রেজ) এমনকি নাচও মিম হইতে পারে। ইন্ডিয়ার সোহম ও মিমি চক্রবর্তী অভিনিত ‘বোঝে না সে বোঝে না’ (২০১২) মুভির ‘নারে নাহ, নারে না ’ নামে একটা হিট গানে নির্দিষ্ট ঢংয়ে নাচের ভঙ্গিটাও আসলে একটা মিম। একইভাবে ইউটিউবের প্রথম গ্লোবাল হিট সং সাই-এর গ্যাংনাম স্টাইল-এর ড্যান্স মুভও মিম। মোদ্দাকথা, সাংস্কৃতিক পরিসরে যার ব্যাপক পুনরুৎপাদন ও পুনর্নিমাণ ঘটে, তারেই মিম বলা যায়।   

মিমের স্বভাব-চরিত্র  

একের সাথে অন্যের মিলমিশের, প্রত্যয়গত (কনসেপ্টুয়াল) ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে এমনকি বিপরীত প্রেক্ষিতের আইডিয়ার মিশেল অর্থাৎ নানান অদ্ভুতুড়ে রিমিক্সিং মিম কালচারের মূল বৈশিষ্ট্য। কালচারে মোটাদাগে এই প্রবণতারে অনেক ক্রিটিক বলেন ‘মেটামডার্নিজম’। মানে হইতেছে মডার্ন সিরিয়াসনেসের সঙ্গে পোস্টমডার্ন আইরনি বা পরিহাসময়তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া। ফলস্বরূপ আশা ও নিরাশা, এমপ্যাথি ও এপ্যাথি, একত্ব ও  বহুত্বের পরিষ্কার অবস্থান দেখা যায় না, চলতে শুরু করে অবিরাম ভাব ও ব্যাঞ্জনাগত দোলাচাল। ইন্টারনেটের দুনিয়া কালচারের এই মেটামডার্ন সেন্সিবিলিটি দিয়া ব্যাপকমাত্রায় প্রভাবিত হয়।              

আর মেটামডার্নিস্ট কালচারের নিখুঁত নমুনা হইতেছে মিম। যেমন, মুভি থেকে একটা স্ক্রিনশট নিয়া, ক্যাপশন যোগ করে সম্পূর্ণ নতুন মানে সৃষ্টি করা। সৃষ্টির এই এপ্রোচ মেটামডার্নিস্ট এপ্রোচ। গ্রেগ ডেমবার এক প্রবন্ধে মেটামডার্নিজমের ১১টা এপ্রোচের কথা বলছেন। মজার বিষয় ঐ ১১টা এপ্রোচের সবগুলাতেই মিমরে বসায়ে দিলে হুবহু মিলে যায়।     

মিমেটিক ছবির একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হইতেছে ফ্রেমের দুই বা ততোধিক উপাদানের মধ্যকার বা টেক্সট ও ইমেজের মধ্যকার অসামঞ্জস্য। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আমরা প্রায়শ দেখি কোনো ব্যক্তি বা বস্তু সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না, ‘যায় না’, অদ্ভুত লাগে। যেহেতু  মিমেটিক ছবি প্রসঙ্গের বাইরের (আউট অব কন্টেক্স) বিষয়ের সঙ্গে পাশাপাশি বসে (জাক্সটাপৌজ), অন্যান্য প্রেক্ষিতে তাদের পুনরায় ব্যবহারকে মোটামুটি স্বাভাবিক লাগে। তাছাড়া ফ্রেমে অরিজিনাল মিমেটিক ইমেজের তীব্র ভিন্নতর সহাবস্থানের পাশাপাশি মনে হয় ফটোশপড, রিপার্পাসড। ফলে আরও নতুন নতুন রাস্তা খুলে দেয় আর অরিজিনাল মিমেটিক ফটোর অসামঞ্জস্যতাকে আরও হাস্যকর রকম অসামাঞ্জস্যপূর্ণ করে ফেলা হয়। নমুনা হিসাবে বিখ্যাত ‘ডিজাস্টার গার্ল’ মিমের কথাই ভাবেন। সে খালি ঘরেই আগুন লাগায় নাই, বরং টুইন টাওয়ারে হামলারও মাস্টারমাইন্ড সে!    

ডিজাস্টার গার্ল, যাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য মিম

ইন্টারনেট মিমের অন্য দুইটা মূল প্রবণতা হইতেছে— সৃজনশীল পুনরুৎপাদন ও ইন্টারটেক্সটুয়ালিটি।  

সৃজনশীল পুনরুৎপাদন মানে বোঝায় মিমের প্যারডি আর নকলের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠা, যা ঘটতে পারে মিমিক্রি বা রিমিক্সের মাধ্যমে। অন্যদিকে, ইন্টারটেক্সুয়ালিটি বলতে বিষয় বা কালচারের বিভিন্ন অসামঞ্জস্যপূর্ণ দিক ও প্রেক্ষিতবিন্দু পাশাপাশি থাকা। যেমন, ‘শীতের সোদন’খ্যাত শামসুল ইসলামের মিমটা দেখেন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ছবিটা শীতকালের জাতীয় ছবি হয়ে উঠছে। অরিজিনাল ভাইরাল ছবির সঙ্গে কালো চশমা যুক্ত হইছে, ঠোটে জয়েন্ট ধরায়ে এক ধরণের থাগলাইফ-সুলভ ‘কুল’ ভাব এনে দিছে। এর সঙ্গেই আবার Winter Is Here কথাটা যুক্ত হয়ে এনে দিছে গেইম অভ থ্রোনজ এর রেফারেন্সের ব্যাঞ্জনা।            

মিমের আয়ু বড়জোর কয়েক ঘন্টা! 
তুর্কি কবি নাজিম হিকমত লিখছিলেন, প্রেমের আয়ু বড়জোর এক বছর। একই ভঙ্গিতে বলা যায়, মিমের আয়ু বড়জোর কয়েক ঘন্টা। পুঁজিবাদের ত্বরিত গতির দুনিয়ায় যেকোনো ট্রেন্ডের ক্ষেত্রে যা সত্য, মিমও স্বল্পায়ু। প্রতিটি আলোচিত ঘটনা এখন অজস্র মিমের জন্ম দেয়। আপাতভাবে এইসব মিমের মৃত্যুও হয় খুব দ্রুত। সফলতম মিমগুলারও আয়ু বড়জোর কয়েক মাস। বেশিরভাগ মিম এক সপ্তাহ টিকলেই সেটা অনেক বড় ঘটনা। অধিকাংশ মিম বানানো হয় তাৎক্ষণিকতার বিবেচনায়। বিভিন্ন ও বিচিত্রভাবে বদলে নেওয়ার সুযোগ যত বেশি মিমে থাকে, সেই মিমের আয়ুষ্কাল বেশি হওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়ে।        

মিমের আয়ুষ্কালের প্রধান নির্ধারণী ভূমিকা রাখে তার সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা। সংস্কৃতি টুকরা এবং সাংস্কৃতিক রেফারেন্সের বাইরে মিম অর্থবহ হইতে পারে না। আগেভাবে বলে দেওয়া যদিও কঠিন, ভাইরাল হয়া যাওয়ার পরে, কোনো মিম কেনো দর্শক-শ্রোতাদেরকে স্পর্শ করতে পারলো বা জনপ্রিয় হতে পারলো তা বোঝা কঠিন নয়। বিরাজমান সাংস্কৃতিক বাস্তবতারে, ও তার সত্যিগুলোরে স্পর্শ করলে তার আয়ুষ্কাল বেশি হওয়া সম্ভাবনা বাড়ে।               
এই ব্যাখ্যা কিন্তু আমাদেরকে অদ্ভুত এক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়ঃ ‘ব্যাড টেক্সটস মেইক গুড মিমস’। অংশগ্রহণমূলক কালচারের নিয়ম যেহেতু ইউজারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, অসম্পূর্ণতা বরং পরবর্তী আরও বাহাসের হুক হিসেবে কাজ করে আর মিমের ছড়িয়ে পড়ায় ভূমিকা রাখে। এ কারণে দেখবেন অসম্পূর্ণ, অমার্জিত, আনাড়ি-সুলভ, এবং উইয়ার্ড টেক্সট, ইমেজ বা ভিডিও মানুষরে যেন শূন্যস্থান পূরণ করতে কিংবা ধাঁধার সমাধান বা ক্রিয়েটরকে মক করতে আমন্ত্রণ জানায়। এই আলাপ ‘শূন্যস্থান হিসেবে কন্টেন্টের ছড়িয়ে পড়া বা বিস্তারযোগ্যতা’ নামে হেনরি জেনকিন্স ও তার সহকর্মীদের দেওয়া তত্ত্বের সাথে মেলে।     

স্প্রেডেবল মিডিয়াঃ ক্রিয়েটিং ভ্যালু এন্ড মিনিং ইন আ নেটওয়ার্কড কালচার বইয়ের প্রচ্ছদ

জন ফিস্কের ‘প্রোডিউসারলি টেক্সট’- কথাটার মূল আইডিয়াও একই। মিডিয়া প্রোডাক্ট এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে অসামঞ্জস্যের শুন্যতা পূরণ করতে আমন্ত্রণ জানায়, এবং দর্শক-শ্রোতা নিজেরা যেন সেই শুন্যতা পূরণ করে, ফলে অর্থবহ হয়ে ওঠে।       

মিম ও পপুলার কালচার  

মিডিয়া তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহানের বিখ্যাত উক্তি ‘মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ’। অর্থাৎ বিষয়বস্তু অনেকাংশেই প্রভাবিত হয় সেটি কোন এবং কেমন মিডিয়ামে হাজির হয় তার প্রযুক্তিগত শর্তসমূহ দিয়া। কাঠামোর দিক দিয়া ইন্টারনেট অন্য সকল মিডিয়ার—- টিভি, রেডিও, খবরের কাগজের— চেয়ে আলাদা।  অন্য মিডিয়াতে তথ্যের একমুখী প্রবাহ ঘটে। এইসব মিডিয়ায় শেয়ার করা আইডিয়া আমজনতার কাছে ছড়ায়ে পড়তো। কী ছড়াবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতো একটা ছোট্ট গ্রুপ— সম্পাদকীয় বোর্ড, মালিকপক্ষ বা ছোট এলিট। কিন্তু ইন্টারনেটে তথ্য প্রবাহের এই নিয়ন্ত্রণ কোনো এলিট গোষ্ঠীর হাতে নাই। ইন্টারনেট ও ইন্টারনেট মিমের মতো বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রাউড। 

জনগনের একটা বড় অংশ কোন জিনিসটা ফানি, ইন্ট্রেস্টিং বা বিরক্তিকর মনে করেছে— তার একটা রোডম্যাপ পাওয়া যায় মিমের ডেটাবেজে। এই দিক দিয়া know your meme কিংবা বাংলায় memelate ধরণের সাইট এই বিবেচনায়,  টাইম ক্যাপসুলের কাজ করে। ভবিষ্যত প্রজন্ম যদি দেখতে পারে যে ২০২৪ সালে কী কী বিষয় ভাইরাল হইছিলো—আমরা কেমন ছিলাম সে ব্যাপারে তাদের স্পষ্টতর ধারণা হবে।  ইন্টারনেট কালচারের মানচিত্রও বলা যায় মিমরে।  

মানুষের আচরণ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে মিম।  যতক্ষণে মিম একটা বড় অডিয়েন্সের কাছে পৌছায়, ততক্ষণে শত শত পুনঃপ্রেক্ষিতকরণের (রিকন্টেক্সটচুয়ালাইজেশন) ভেতর দিয়ে গেছে। অরিজিনাল ইমেজ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ট্যাগলাইন ও প্রেক্ষিত থেকে নতুন মিম বানায়, স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান যেমন পুরনো জোকরে নতুন প্রেক্ষিতে হাজির করে। আর যে ভার্শনটা ভাইরাল হয় সেইটা প্রকাশ করে আমাদের ঠিক কোন জিনিসটা স্পর্শ করে।  

ইন্টারনেট মিমে পপ কালচারের ভূমিকা বুঝতে, আমাদেরকে প্রথমে বোঝা দরকার, মিমে সমকালীন পপুলার কালচারের প্রতিফলনই মূলত ঘটে। ফলে এর মধ্যে সামাজিক প্রথা, যৌথ অভিজ্ঞতা ও ক্রমপরিবর্তনশীল ট্রেন্ড চলে আসে। অধিকাংশ ইন্টারনেট মিমের উৎপত্তি পপুলার কালচারে। ক্লাসিক মুভি, টিভি সিরিজ, মিউজিক এমনকি রাজনৈতিক ঘটনাও মিম সৃষ্টির মূল হিসেবে কাজ করতে পারে। পপুলার কালচারের আইকনিক ক্যারেক্টার, চলতি বুলি, ও স্মরনীয় মুহূর্ত ইন্টারনেট মিমে নতুন জীবন পায়। একটা উদাহরণ ‘ডিস্ট্র্যাকটেড বয়ফ্রেন্ড’ মিম এ দেখা যায় এক  পুরুষ অন্য নারীর দিকে তাকাচ্ছে, আর পাশেই তার প্রেমিকা সেটে দেখে রেগে আছে। ইউজাররা এই ইমেজটা আদি প্রেক্ষিতের বাইরেও অজস্র প্রেক্ষিতে ব্যবহার করে। ফলে মিমের ভাইরাল টেমপ্লেট হয়ে উঠেছে।  

মানুষ রিলেট করতে পারে বা যারে ঘিরে তারা বন্ধন তৈরি করতে পারে—এমন যৌথ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পপ কালচার।
মিম এই যৌথ অভিজ্ঞতাকে স্পর্শ করে এবং এক ধরণের আত্মীয়তার বোধ জাগায়। একটা প্রিয় মুভি হোক, বিখ্যাত মিউজিশিয়ান বা রিয়ালিটি শো’র মুহূর্ত হোক, মিম যৌথ সংস্কৃতির এই স্পর্শবিন্দুকে স্পর্শ করে মানুষকে একত্র করে। মিম কেবল পপ কালচারের প্রডাক্ট নয়; মিম সেই কালচারের ক্রিটিক ও ভাষ্য রচনার হাতিয়ারও। ট্রেন্ড, সেলেব্রিটি বা সামাজিক ইস্যুতে স্যাটায়ারিকাল ও ক্রিটিকাল পার্স্পেক্টি হাজির করে। বিজ্ঞাপনের এবসার্ডিটি বা সেলেব্রিটি স্ক্যান্ডাল নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে মিম একটা পরিসর হাজির করে যেখানে আইরনি ও হিউমারের মাধ্যমে কালচারাল ও পলিটিকাল ডিস্কোর্সে অংশ নিতে পারে।      

মিমের দ্রুত চেহারা বদল 

ইন্টারনেট মিমে পপ কালচারের প্রভাব ডাইনামিক ও ক্রম-বিবর্তনশীল। পপ কালচাররে নতুন ঘটনা অনুযায়ী মিমও এ্যাডাপ্ট করে নেয়। কোনো নতুন স্ট্রিমিং সিরিজ, রাজনৈতিক ঘটনা, ক্যাচি টিউন জনপ্রিয়তা পাইলে, ইন্টারনেট দ্রুত এইসব সাংস্কৃতিক মুহূর্তকে মজাদার ও রিলেটেবল মিমে রূপান্তরিত করে।  

পপ কালচার আর মিম কালচার বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে না। একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই সাংস্কৃতিক চক্র সৃষ্টির মাধ্যমে  কাজ করে। মিম পপুলার কালচার থেকে যেমন প্রেরণা নেয়, অন্যদিকে পপ কালচারের বিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। মিম পুরনো মিডিয়ায় আগ্রহ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ক্লাসিক ফিল্ম বা মিউজিকরে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারে, এবং অবশ্যই ব্র্যান্ড ও সেলেব্রিটিদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজিতে ভূমিকা রাখতে পারে।  


মিমের ভবিষ্যৎ  

ভবিষ্যত সম্পর্কে বলা কঠিন। ভবিষ্যত নিয়া আসে অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা। এইটা ক্রমশ বিবর্তমান প্রযুক্তি, কালচার, ও সামাজিক গতিশীলতা দিয়া প্রভাবিত হয়। তবে প্রযুক্তির গতিপ্রকৃতি দেখে অদূর ভবিষ্যতের মিমের প্রবণতা সম্পর্কে মোটাদাগে কিছু মন্তব্য করা সম্ভব। যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানের পরে, আমরা এআই জেনারেটেড মিমের আধিক্য ভবিষ্যতে দেখতে পারি। এখন বেশিরভাগ মিমের কন্টেন্ট কোনো নাটক-সিনেমা বা বাস্তবজীবনের ভাইরাল ছবি থেকে করা হয়। কিন্তু এআইএর ফলে অরিজিনাল ইমেজটাই কৃত্রিমভাবে নির্মিত হইতে পারে। মিম বানানোর ক্ষেত্রে, আগামী দিনগুলিতে ডিপফেইক প্রযুক্তির ব্যবহারও নিশ্চয়ই বাড়বে। ফলে বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য আরও কমে আসবে।   

বিশাল ফলোয়ারওয়ালা এআই জেনারেটেড ক্যারেক্টারগুলো, যাদেরকে বলা হয় ভার্চুয়াল ইনফ্লুয়েন্সার, মিমরে তাদের কন্টেন্টে নিয়া আসতে পারে। ফলে তৈরি হবে ইন্টারনেট মিমের নতুন ধরণের ভ্যারিয়েশন। ইন্টারনেট বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ ক্রমশ বাড়ানোর ফলে, আমরা হয়তো আরও বেশি বৈচিত্র্যময় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রেফারেন্স মিমে দেখবো; বৈশ্বিক ফিউশন একই মিমের মধ্যে হয়তো দেখা যাবে। আর এর ফলে প্রকৃত বৈশ্বিক মিম কালচারের উত্থান দেখবো। মিম কালচারের ক্রমবর্ধমান জটিল অবস্থা ও সচেতনতার ফলে, আমরা এমন মিমও হয়তো দেখবো যে মিম নিজেই মিম-কালচার ও মিমের প্রকৃতি নিয়া কমেন্ট করবে, চুটকি করবে, বা মিম ট্রেন্ড এনালিসিসও মিমের মধ্যে ঢুকে পড়বে। এরে মেটামিম বলা যাইতে পারে। যত রকম পরিবর্তনই আসুক না কেন, মিম যে বড় একটা সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে থেকে যাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। যতদিন দুনিয়াতে ইমেজের প্রতি নির্ভরতা থাকবে, ভার্চুয়াল ও রিয়ালের মধ্যে ব্যবধান কম থাকবে, ততদিন মিমও আমাদের নিত্যদিনের এক্সপ্রেশনের অন্যতম ফিচার হিসেবে থাকবে। 

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।