কমলা ভাসিন–এর নারীবাদ পরিচিতি । পর্ব-২ 

kamla bhasin
কমলা ভাসিন

এটা কি সত্যি যে, নারীবাদীরা পুরুষতন্ত্রের বদলে মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

প্রশ্নটি নারীবাদ সম্পর্কে সামগ্রিক ভুল বোঝাবুঝিকেই তুলে ধরে অথবা এটি নারীবাদকে কলঙ্কিত করার একটি প্রয়াস। আপনি কি এমন কোনও নারীবাদীর কথা শুনেছেন যিনি বলেছেন অথবা লিখেছেন যে তিনি পুরুষতন্ত্রের বদলে মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান? যদি আপনি এমন উক্তি স্মরণ করতে না পারেন, তবে নারী-পুরুষ সমতা মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব অক্ষমতা থেকে সম্ভবত এই প্রশ্ন উদ্ভুত হয়। 

এতে প্রতীয়মান হয় যে, কিছু মানুষ শুধুমাত্র ক্ষমতার ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাস ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করতে পারেন না। 

নারীবাদীদের অবস্থান, দাসত্ব, ক্ষমতার স্তরবিন্যাস এবং সকল প্রকার অসমতার বিরুদ্ধে এবং তার স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে। 

বলা হয়ে থাকে, যখন কোনও নারী পুরুষের মতো হয়,  তখন সে হয় একটি ডাইনি, কিন্তু একজন পুরুষ যখন নারীসুলভ গুণ অর্জন করে তখন সে হয় একজন সাধু। তাহলে কেন নারীবাদীরা পুরুষের মতো হতে চায়? 

প্রথমত, আমরা বিশ্বাস করি না বা স্বীকার করি না যে, পুরুষদের এক ধরণের বৈশিষ্ট্য আছে বা থাকা উচিত এবং নারীদের আরেক ধরণের আরেক ধরণের। আমরা বিশ্বাস করি যে, পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যেই তথাকথিত ‘পুরুষসুলভ’ গুণ (শক্তি, সাহসিকতা, নির্ভীকতা, কর্তৃত্ব, প্রতিযোগিতার মনোভাব ইত্যাদি) এবং তথাকথিত ‘নারীসুলভ’ গুণ (যত্ন, সেবা ভালোবাসা, ভীরুতা, বশ্যতা ইত্যাদি) থাকতে পারে বা বিকাশ লাভ করতে পারে। এই সবই মানবীয় গুণ পুরুষের জন্য আর কিছু নারীদের জন্য আলাদাভাবে ধার্য করে দেয়। এটি চাপিয়ে দেয়া গুণাবলিরই ফলাফল যা প্রভাবশালী, অসহিষ্ণু, আক্রমণকারী পুরুষ ও অনুগত, মেরুদণ্ডহীন, ভীতু নারী তৈরিতে প্রণোদনা দেয়। আমরা চাই যে, মেয়ে এবং ছেলে, নারী এবং পুরুষ উভয়েই ইতিবাচক ‘পুরুষসুলভ’ এবং ‘নারীসুলভ’ গুণাবলি পরিহার করে তাদের সামর্থ্যের  বিকাশ ঘটাতে পারবে। 

আমাদের প্রত্যেকেরই মধ্যেই নারী এবং পুরুষ উভয় গুণাবলি আছে এবং উভয় গুণাবলির অনুশীলন প্রয়োজন। 

নারীবাদীরা কখনও পুরুষদের নেতিবাচক গুণাবলি এবং বৈশিষ্ট্যাবলি গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। এই পৃথিবী ইতোমধ্যেই পুরুষদের হিংস্রতা এবং আক্রমণে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে এবং এর জন্য অতিরিক্ত উৎপীড়নের প্রয়োজন নেই।  আসলে, আমরা বরং চাই যে পুরুষরাও আরও বেশি নারীদের মতো হয়ে উঠুক, অর্থাৎ তারা সন্তানদের এবং বৃদ্ধদের দেখাশোনা ও যত্ন করবে, সংসার পরিচালনা করবে ইত্যাদি। এর ফলে পুরুষরা আরও ভদ্র, অনুভুতিপ্রবণ এবং হৃদয়বান হয়ে উঠবে এবং নারীদের অনেক কাজের ভার লাঘব হবে। 

যদিও সাহসিকতা, নির্ভীকতা, যৌক্তিকতা, দক্ষতা ইত্যাদি গুণাবলি পুরুষের বলে বিবেচিত হয়, তথাপি নারীদের অবশ্যই এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন এবং অনুশীলন করা উচিত। 

নারীবাদীরা কি পুরুষবিদ্বেষী?

নারীবাদীরা পুরুষদের ঘৃণা করে না। তারা পিতৃতন্ত্র, পুরুষের আধিপত্য এবং পুরুষের মধ্যকার পুরুষালি আচরণের বিরুদ্ধে। যেসব নারী পুরুষের আধিপত্য, আক্রমণ ও হিংস্রতাকে নৈতিকভাবে সমর্থন করে, নারীবাদীরা তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। নারীবাদীরা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং আদর্শের বিরোধী। এই আদর্শ ও ব্যবস্থা পুরুষকে উৎকৃষ্ট বলে বিবেচনা করে এবং তাদেরকে অধিক অধিকার ও সুযোগ প্রদান করে। 

সকল ব্যবস্থা ও নিয়মকানুন মানুষই টিকিয়ে রাখে। কোনও নিয়ম বা ব্যবস্থা কখনও কখনও নারীকে ধর্ষণ অথবা নির্যাতন করে না, করে একজন পুরুষ। নিয়ম কোনও দিন কন্যাসন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে না, করে একজন পিতা। 

সুতরাং, আমরা সেই সব পুরুষের বিরুদ্ধে, যারা নারীদের নিজেদের সমান বলে স্বীকার করে না, যারা নারীদের নিজেদের সম্পত্তি বলে গণ্য করে এবং পণ্য বলে বিবেচনা করে। 

দুর্ভাগ্যবশত অনেক পুরুষই আধিপত্য বিস্তারকারী এবং তাদের ভিতরে এ ধরণের গুণাবলি রয়েছে। এমনকি অনেক অতি উৎসাহী গণতান্ত্রিক এবং সমাজবাদী পুরুষের ক্ষেত্রেও এ তথ্য সত্য। তারা সমাজে সাম্যের বানী প্রচার করে অথচ বাড়িতে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই সাম্য অনুশীলন করে না।

আমরা অবশ্য বিশ্বাস করি, নারী যেমন প্রাকৃতিকভাবেই যত্নশীল এবং সেবাপরায়ণ নয়, পুরুষও তেমনি প্রকৃতিগতভাবেই আক্রমণাত্মক এবং আধিপত্য বিস্তারকারী নয়। তারা আসলে শিশুকালের শিক্ষাদীক্ষা পদ্ধতি এবং সামাজিক অবস্থার শিকার। যার ফলে সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত ভাবমূর্তির ফাঁদে তারা আটকে আছে।  

আমাদের সমস্যা হলো যে অধিকাংশ পুরুষ এই বিষয়টি স্বীকার করে না এবং খুব অল্পসংখ্যক পুরুষই এই ব্যাপার থেকে নিজেকে মুক্ত করে মানবিক এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে। তাছাড়া, কিছু পুরুষ নারীদের দ্বারা প্রস্তাবিত যে কোনও পরিবর্তনের বিরোধী। 

যে নারীরা পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে, সমর্থন করে অথবা ঠিক বলে মনে করে তাদেরকেও নারীবাদীরা যথেষ্ট সমালোচনা করে। অন্যভাবে বলা যায়, যারা স্বৈরতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক, আক্রমণাত্মক, তাদেরকেও নারীবাদীরা সমালোচনা করে। আমাদের অনেকেই ম্যাডেলিন অলব্রাইটের মতো নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। 

জেন্ডার সমতার ইস্যুটি নারী এবং পুরুষের মধ্যকার বিরোধ নিয়ে নয়। বরং যারা নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করে এবং সমতা চায় এবং যারা তা চায় না বরং পুরুষের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়, তাদের মধ্যকার বিরোধ।

আমরা সবাই জানি যে, এই উভয় শিবিরে পুরুষ ও নারী আছে। অনেক পুরুষই আজকাল তাদের পুরুষত্ব, তাদের অধিকার এবং আচরণের নমুনা পরীক্ষা করে দেখছে। এই প্রথমবারের মতো পুরুষের বিভিন্ন গুণাবলি, পুরুষের শক্তি, পুরুষের যৌনশক্তি, পুরুষের জ্ঞানপদ্ধতি, পুরুষের যুদ্ধকৌশল, পরীক্ষা নিরীক্ষার সম্মুখীন এবং পরীক্ষাকারীদের মধ্যে পুরুষ এবং নারী উভয়ই আছে। সুতরাং নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের জন্য লড়াই করাটা নারী ও পুরুষের মধ্যে যুদ্ধ, এই রকম চিন্তা করাটা ভুল।

এ লড়াইটি হচ্ছে দুটি মতাদর্শ ও বিশ্বাসের মধ্যে। এর দিকে রয়েছে যারা নারী-পুরুষের বৈষম্য ও উপর নিচের ধারণাকে বাতিল করে সমতা, ন্যায়বিচার, উঁচু-নিচু ধাপমুক্ত সমাজ গড়তে চায়, অন্যদিকে রয়েছে যারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।

এটা অস্বীকার করা যায় না যে, পুরুষ এবং নারীর মধ্যে কিছু মেরুকরণ এবং স্বার্থগত দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্ব অবশ্যই এই জন্য নয় যে, তারা কেউ পুরুষ এবং কেউ নারী। বরং এর পেছনে কারণটি হলো নারী-পুরুষভিত্তিক শ্রমবিভাজন যা তাদের উপর চাপানো হয়েছে এবং যা বিভিন্ন দায়িত্ব ও তার পথ ধরে ভিন্ন ভিন্ন অধিকার ও চাহিদার সৃষ্টি করেছে। এই মেরুকরণ এবং দ্বন্দ্ব অবশ্যই স্বীকার করতে হবে এবং তার নিরসনে কাজ করতে হবে। 

এই সবকিছুই মনে হয় যুক্তিপূর্ণ। তবে নারীবাদকে এত ভয় কেন? কেন একে হাস্যকর এবং ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়? কেন এটা এত বিরোধিতার মুখোমুখি হয়? 

এটা সত্য যে, অনেকেই নারীবাদের বিরুদ্ধে যাবতীয় গুজবকে বিশ্বাস করতে ও নারীবাদীদের বিরুদ্ধে প্রচারকে সমর্থন করতে খুবই আগ্রহী। তারা নারীবাদীদের সমালোচনা এবং উপহাস করতেও খুব পছন্দ করে। এর কারণ, নারীবাদ সম্বন্ধে তাদের একটা নিজস্ব অস্বস্তি রয়েছে। সময় সময় এই অস্বস্তি হাস্যকর কৌতুক হিসেবে প্রকাশ পায় (তুমি কি সেই ব্রা পোড়ানোদের দলের কেউ হা হা হা), কখনও কখনও ভয় ( শোনো, আমার স্ত্রীর কাছে খুব বেশি সময় থেকো না। আমি ঘরে কোনো নারীবাদ চাই না।)। কখনও কখনও এরা নারীবাদীদের সরাসরি আক্রমণ করে বসে। 

আবার কোনও নারীবাদীর ব্যক্তিগত দূর্বলতা এবং ভুলগুলোকে ‘নারীবাদের দোষ’ হিসেবে দেখা হয়। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি একজন নারীবাদী ধূমপান করে অথবা মদ্যপান করে, তবে তার জন্য নারীবাদকেই দোষারোপ করা হয় না। লোকেরা শ্রমজীবী শ্রেণির নারীদের ধূমপানকে দোষ মনে করে না। অনেকে মনে হয় এটাও ভুলে যায় যে, যেসব নারীরা নারীবাদকে অনুসরণ করে বং সমর্থন করে তারাও মানুষ এবং এই কারণে তারাও ধূমপান করতে পারে, মদ্যপান করতে পারে, রেগে যেতে পারে, অযৌক্তিক আচরণ করতে পারে, বাচ্চাদের অবহেলা করতে পারে ইত্যাদি।  

আমাদের দুর্বলতা এবং ভুলের জন্য নারীবাদ দায়ী নয়। আমরা নারীরা মানুষের অধিকার চাই। আমাদের দুর্বলতা এবং ভুল কাজের দায়িত্ব স্বীকার করি। 

অনেক কর্মজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারী ধূমপান করে, তাদের পছন্দমতো জামাকাপড় পরে, তাদের পছন্দমতো কেশবিন্যাস করে। যার মাধ্যমে তারা নারীবাদী চিন্তা-চেতনার চেয়ে তাদের স্বনির্ভরতা এবং স্বাধীনতার চিহ্নকেই ফুটিয়ে তোলে বেশি। আসলে, এইসব ‘সাহসী’ নারীদের অনেকেই হয়তো নারীবাদী হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। নারীবাদকে যে অনেকেই হুমকি বলে মনে করে তা মোটেই বিস্ময়কর নয়। তারা সততার সঙ্গেই বলে, ‘তোমরা জানো যে, আমরা নারীর কল্যাণ বা এই ধরণের কোনও কিছুর বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এই নারীবাদ আসলেই একটা সমস্যা।’ 

এর বিভিন্ন কারণ আছে। সব ধর্মের নেটারাই নারীবাদীদেরকে অপছন্দ করে। তার কারণ, নারীবাদীরা সব সময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও নারীবিরোধী ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন ও ঐতিহ্যের সমালোচনা করে থাকে। কোনও কোনও সময় ধর্মীয় নেতাদের ক্রোধ এত তীব্র হয়ে যায় যে, তারা বলিষ্ঠ নারীবাদীদের মৃত্যুদন্ডের চেয়ে কম কোনও শাস্তি প্রদানের দাবি ওঠে এবং পাকিস্তানে নারীবাদীদের এবং মানবাধিকার আইনবিদ ও কর্মীদের বিরুদ্ধে অবিরত হুমকি দেয়া হয়। 

অনুরুপভাবে, অনেক দেশেই ক্যাথলিক চার্চগুলো সেইসব নারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত রয়েছে যারা তাদের সন্তান জন্মদান এবং নিজ শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডানপন্থী খ্রিষ্টানরা গর্ভপাতের বিরোধিতা করে। তারা শুধু যারা গর্ভপাত করছেন সেই সকল নারীর বিরুদ্ধেই হিংস্র হচ্ছে না, বরং তারা সেই সব ডাক্তারকেও হত্যা করছে যারা নারীদের গর্ভপাত ঘটাচ্ছে। ডানপন্থী ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা নারীবাদীদের পরিবারবিরোধী, ঐতিহ্যবিরোধী এবং ধর্মবিরোধী বলে অভিযুক্ত করছে। 

দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় নেতারা নারীবাদীদের দ্বারা আনীত প্রগতিশীল পারিবারিক আইনের তীব্র বিরোধিতা করছে। পুঁজিবাদী পুরুষরাও বিশেষভাবে নারীবাদের বিরোধী। কারণ, তারা জানে যদি নারীরা সচেতন হয় তবে তারা ক্রেতা হিসাবে আর চালাকির শিকার হতে চাইবে না,  এবং অল্প মজুরি, নিচু মানের কাজ আর গ্রহণ করবে না। 

বর্তমানে তারা সেই ধরণের কাজগুলোর মাঝেই অবরুদ্ধ হয়ে আছে। তারা ওই সকল নারীবাদীদের ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন যারা পর্নোগ্রাফি (যা নারীদের যৌন বস্তুতে পরিণত করে তোলে), প্রসাধনী শিল্প (যা সৌন্দর্য্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করে), শিশুখাদ্য (যা বিপুল পরিমাণ শিশুমৃত্যুর কারণ), জন্ম নিবারক (যা তৃতীয় বিশ্বের নারীদের গিনিপিগ হিসাবে গণ্য করছে এবং অনিরাপদ জন্ম নিবারণ পদ্ধতি সরবরাহ করছে), ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। এ সকল ইন্ডাস্ট্রিতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে, এগুলোর মালিকদের আয়ত্তে আছে প্রচুর সম্পদ যার দ্বারা তারা তাদের অসৎ অভিসন্ধির বিরুদ্ধে যে কোনও চ্যালেঞ্জ বা হুমকি নস্যাৎ করে দিতে সমর্থ। 

সামরিক প্রতিষ্ঠানও নারীবাদীদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। নারীবাদীরা বেশিরভাগই যুদ্ধবিরোধী এবং শান্তি আন্দোলনের পুরোভাগে আছেন। 

প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত ব্যক্তিরাও নারীবাদীদের ব্যাপারে অস্বস্তিবোধ করেন। কারণ, নারীবাদী পন্ডিতরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুবর্তিতা এবং রীতি-নীতির ক্ষেত্রে যে পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতিত্ব বিরাজমান সেগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরছেন। বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সদস্যরাও এইসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে নারীদের প্রতি যে আচরণ করা হয় সে সম্পর্কে নারীবাদীরা যে প্রশ্ন করে থাকে তা অপছন্দ করে। 

আর একটি কারনে সাধারণ মানুশ নারীবাদীদের ব্যাপারে অস্বস্তিবোধ করে। তার কারণ সম্ভবত এই যে, এই একটিমাত্র মতাদর্শ ঘরের পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন করেছে। আমাদের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে, আমাদের একান্ত বিশ্বাস, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আচরণের ধরণগুলো সম্পর্কে, এমনকি আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছে। এ কারণেই নারীবাদ হুমকি হিসেবে গণ্য হয়। 

একবার যখন নারীরা পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে তখন আমরা অনিবার্যভাবেই আমাদের নিজেদের বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র এবং বন্ধুদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরি। কেননা এ সেই পুরুষ যারা পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের জন্য মূর্ত করে তুলেছে। 

সমাজের প্রতিটি স্তরে আন্তঃব্যক্তিক ও পারিবারিক সম্পর্ক এবং উভয় ক্ষেত্রে বিদ্যমান সামাজিক স্থিতাবস্থাকে নারীবাদ চ্যালেঞ্জ করে। 

পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতি চ্যালেঞ্জ পুরুষদের জন্যই শুধু বেদনাদায়ক নয় বরং ওই সকল নারীদের জন্যেও বেদনাদায়ক যারা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তাদের জন্যও বেদনাদায়ক যাদের কাছে সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষা করা অধিক প্রয়োজনীয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে নারীরাই কেবল লাভবান হতে পারে। কারণ, ‘তাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই’’। নারীবাদীরা যে নতুন সমাজ গঠন করতে চায়, তা করতে অনেক পুরুশ এগিয়ে আসতে পারে। তবে তাদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ পরিহার করতে ইচ্ছুক নয়। 

অনেক সময় আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, পুরুষতান্ত্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করা ঠিক কিনা? এটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কিনা? আমরা যদি সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের গৃহে, কর্মক্ষেত্রে এবং সমাজে সংঘটিত অতিসূক্ষ্ম লিঙ্গ বৈষম্যগুলোর মুখোমুখি হই তবে আমরা কষ্টদায়ক পরিস্থিতি এড়াতে পারবো কিনা? 

আমাদের স্বামীরা যখন আমাদের শ্রমের ফলে লাভবান হয় অথবা যখন তাদের কাজ বা পেশা আমাদের কাজ বা পেশার চাইতে অগ্রাধিকার পায়, তখন আমরা কী করি? 

একজন মেয়ে শিশু যখন দেখে যে, তার ভাইকে বেশি খাবার দেয়া হয়, স্কুলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয় এবং অন্য যে কোনও বিষয়ে তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, তখন সে কী করে? যখন একজন কন্যা সন্তান পারিবারিক সম্পত্তিতে ভাগ পায় না অথবা একজন পুত্র যখন একজন পুরুষ হিসেবে মায়ের উপর তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দেয়, তখন কী ঘটে সেই কন্যা বা সেই মায়ের? 

আমাদের নিয়ে যখন ঠাট্টা মশকরা করা হয়, আমরা যখন অপমানিত হই এবং আমাদের উপর নির্যাতন করা হয়, তখন আমরা কী করি? 

যদি এই ধরণের আচরণের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদের ইঙ্গিতও হুমকি হিসাবে দেখা হয়, তা আশ্চর্যের কিছু নয়। কারণ যে কোনও চ্যালেঞ্জই বিদ্যমান সামাজিক অবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। 

জেন্ডার বিষয়টি যে খুবই ব্যক্তিগত এবং সে কারণে খুবই স্পর্শকাতর ও আবেগময় একটি বিষয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এগুলো আমাদের শুধু বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যথা, স্কুল-কলেজ, আইনি ব্যবস্থা, রাষ্ট্র, পুঁজিবাদ ইত্যাদির বিষয়ে মুখোমুখি হতেই বাধ্য করছে তাই নয় বরং আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক (স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, মা-মেয়ে) এবং আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলোরও মুখোমুখি করেছে। অনেক সময়ই ভিন্ন স্বার্থের কারণে দুটি ভিন্ন দল/সম্প্রদায়ের মাঝে দ্বন্দ্ব হয়।  একই পরিবারের সদস্যদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। অনেক সময় একই ব্যক্তির দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মাঝেও দ্বন্দ্ব দেখা যায়। 

আমাদের কোনও একটি পক্ষ সমর্থনের প্রয়োজন হলে অনেক সময় এমন হয় যে, দুটোর ভেতর একটি বেছে নিতে বেশ কষ্ট হয়। আমরা হতভম্ব হয়ে যাই যখন আমরা আবিষ্কার করি যে, আমাদের খুব কাছের লোকেরা আমাদের স্বার্থে আঘাত হানছে, আমাদেরকে নানাভাবে শোষণ করছে এবং আমাদেরকে সমান দৃষ্টিতে গ্রহণ করছে না। 

সচেতনতা বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া প্রকৃতপক্ষে খুবই বেদনাদায়ক। শুধু পুরুষরাই নয় বেশিরভাগ নারীও এই ধরণের অবস্থার মুখোমুখি এবং হতভম্ব হওয়ার পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চায়। আমরা নারীবাদ নিয়ে অস্বস্তি বোধ করি। কারণ, নারীবাদ আমাদের নারীদেরকেও চ্যালেঞ্জ করে। আমরা কীভাবে শোষিত হই, আমাদের নারীত্বকে কীভাবে ব্যবহার করি, মেয়েলি আচরণ নিয়ে খেলা খেলি, অন্যদের কিভাবে শোষণ করি, পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানের অগণতান্ত্রিক এবং কর্তৃত্বপূর্ণ হয়ে উঠি, এ সবকিছুর প্রতিও নারীবাদ সমালোচনাপূর্ণ দৃষ্টি দেয়। 

অন্য কথায়, আমাদের নারীদের ভেতরে যে পুরুষতান্ত্রিকতা আছে, পুরুষসুলভ উৎপীড়ন ও ক্ষমতালোভের যে উৎস আছে, নারীবাদ সেগুলোকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য চ্যালেঞ্জ করে। মোট কথা, নারীরাও যে নিজেদের ভেতরে পুরুশতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ধারণ করে। আমরাও পুরুষদের মতো একইভাবে পুরুশতান্ত্রিক পরিবারে বড় হই, একই ধর্মীয় ঐতিহ্যে বেড়ে উঠি এবং একই পুরুষতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করি। যার ফলে, বহু নারীই বিশ্বাস করে যে, পুরুষরাই শ্রেষ্ঠ; তারাও তাদের কন্যাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। তাদের গতিবিধির উপর, পছন্দ অপছন্দের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, তাদের কন্ঠ রোধ করে। দীর্ঘ সময় ধরে যা আমরা বিশ্বাস করে আসছি, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা এবং তা পরিবর্তন করা আমাদের নারীদের জন্যেও খুবই কষ্টদায়ক। 

মারিয়া মাইস-এর মতানুযায়ী, আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারী এবং পুরুষ, সামাজিক লিঙ্গীয় সম্পর্কগুলোর প্রকৃত রূপ পরীক্ষা করার ব্যাপারটি এড়িয়ে চলে। কারণ, তারা ভয় পায় যে অর্থ উপার্জন, শক্তির খেলা এবং আকাঙ্ক্ষার এই শীতল নৃশংস পৃথিবীতে শান্তি ও সংহতির শেষ দ্বীপ পরিবারটি এই কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 

এছাড়া, যদি তারা এই বিষয়ে সচেতন দৃষ্টি দেয়, তাহলে তাদের স্বীকার করতে হবে যে, তারা (নারীরা) নিজেরাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, পুরুষরা যাদেরকে ভিলেন হিসেবে গণ্য করে তারাও নারীর মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তারা উভয়েই দুষ্কর্মের সহচর। যদি তারা সত্যিই স্বাধীন ও মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় তবে তাদেরকে এই দুষ্কর্মের সহচর হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

এটা শুধু সেসব পুরুষদের জন্যই সত্য নয় যাদের সুবিধার শিকড় এই ব্যবস্থা মধ্যে নিহিত রয়েছে এটা ঐ সকল নারীদের জন্যও সত্য যাদের বস্তুগত অবস্থান এর সঙ্গে যুক্ত। 

নারীবাদীরা কোনও বড় সফলতা অর্জন করেছে সেখানেই প্রতিপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে তীব্র নিপীড়নমূলক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কয়েক বছর আগে কানাডায় এক ব্যক্তি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে ১৪ জন ছাত্রীকে গুলি করে এবং তারপর আত্মহত্যা করে। সে যে চিঠি রেখে যায়, তাতে সে স্পষ্টভাবেই বলেছে যে, সে ‘নতুন নারীদের’ উপর খুবই ক্ষুব্ধ। 

কিছু মানুষ মনে করে বিশ্বব্যাপী পর্নোগ্রাফি এবং নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার যে বৃদ্ধি ঘটেছে তা নারীদের তাদের আগের স্থানে নিয়ে যাবার একটি প্রচেষ্টা। দক্ষিণ এশিয়ায় যে সকল নারী পর্দা নিয়ে তাদের শরীর ঢেকে রাখে না, তাদের কারও কারও উপর এসিড নিক্ষেপ করার ঘটনা ঘটে এবং নারীদের অনাবৃত বাহুতে আঘাত করা হয়। 

নিম্নবর্ণের হিন্দুরা, কৃষকরা, শ্রমিকরা, কৃষাঙ্গরা যখন সংগঠিত হয় এবং বিদ্যমান অন্যায় ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে তখন তাদের বিরুদ্ধে যে হিংস্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়, তার সঙ্গে নারীদের বিরুদ্ধে যে সকল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার কী কোনও পার্থক্য আছে? 

নারীবাদীদের বিরুদ্ধে শত্রুতা কেবল এ কথাই প্রমাণ করে যে, নারীবাদীরা এমন একটি সুরক্ষিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে, যেখানে শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তি লাভবান হয়। ঐ সকল ব্যক্তির সুবিধা এবং মুনাফাসমূহ হুমকির সম্মুখীন হওয়ার ফলে তারা প্রকাশ্যে শত্রুতা এবং নারীবাদীদের বিরুদ্ধে প্রচারণার আশ্রয় নিচ্ছে।

যুক্তি পুরুষদের মুক্তির সঙ্গে নারীর মুক্তি সম্পর্কিত হয় এবং যদি  তারাও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফাঁদে বন্দি হয়ে থাকে, তবে তারা নারীবাদের ব্যাপারে এত ভীত কেন? 

সব পুরুষই নারীবাদের ব্যাপারে ভীত নয় এবং তারা সকলেই এর বিরুদ্ধেও নয়। তবে বিপুলসংখ্যক পুরুষ ভীত এবং এর বিরুদ্ধে। কারণ, বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের জন্য সুবিধাজনক। তাছাড়া নারীবাদ পুরুষ প্রাধান্য ও পুরুষ কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এবং প্রাকৃতিক জেন্ডারভিত্তিক পুরুষ আধিপত্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। এটা পুরুষদেরকে তাদের মনোভাব, আচরণ এবং পদমর্যাদা পুনরায় পর্যালোচনা করে দেখতে চাপ দেয়— যা মোটেও সহজ বা আনন্দদায়ক নয়। মোটের উপর, কোনও শাসকই স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করে না। 

বর্তমান ব্যবস্থায় পুরুষদের সুযোগ-সুবিধা অসংখ্য, তাদের জন্মের মুহূর্ত থেকেই উচ্চমর্যাদা, ভালোবাসা এবং সম্মান দেওয়া শুরু হয়। ছেলে শিশুদের জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো খাবার, ভালো চিকিৎসা এবং ভালো শিক্ষার সুযোগ থাকে এবং একইভাবে তাদের স্বাধীনতাও থাকে— চলাফেরার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের এবং পছন্দের স্বাধীনতা।

পুরুষরা উত্তরাধিকারসূত্রে নারীদের চেয়ে বেশি পৈত্রিক সম্পত্তি পায় এবং অনেক আইন এখনও পুরুষদের অনুকুলে, পক্ষপাতমূলক। 

শতকরা নব্বই ভাগের উপর সংসদীয় আসন এবং শতকরা ৮০ ভাগের উপর ব্যবস্থাপক পদ দখল করে আছে পুরুষরা। নারীবাদীরা নারী-পুরুষের অসম সম্পর্কের ব্যাপারে নীরবতা ভেঙেছে এবং পরিবারের ভেতরে যে অসমতা এবং নির্যাতন রয়েছে তা প্রকাশ করেছে। তাই পুরুষরা স্বনির্ভর ও সাহসী নারীদেরকে ভয় পায়। তারা ভীত যে, নারীরা চাকরির জন্য তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে। 

নারীদের ভূমিকাকে যদি শুধুমাত্র গৃহিণীর কাজ বলে গণ্য করা হয়, তবে প্রয়োজনের সময় তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে রাখা যায় এবং প্রয়োজন ফুরালে তাদের যখন তখন ছাঁটাই করা যায়। 

যদি নারীদের ভূমিকা সম্পর্কিত সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা যায় এবং নারীদের যোগ্যতা ও ক্ষমতা প্রকাশের সামর্থ্য বৃদ্ধি পায় তবে এই ধরণের বৈষম্য অব্যাহত রাখা আর সম্ভব হবে না। সকলেই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে, পুরুষ বা নারী হিসেবে নয়। তবে পুরুষরা কখনও এই অনিবার্যতাকে বিশেষভাবে স্বাগত জানাবে না। 

নারীবাদ বিদ্যমান সামাজিক অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সমাজের মৌলিক পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করে। এর ফলে পুরুষরা তাদের বর্তমান অন্যায্য সুবিধাদি হারাবে। এই জন্যে তারা নারীবাদকে ভয় পায়। 


তার মানে কি এই যে, পুরুষরা যদিও উপলব্ধি করতে পারছে না, তবুও শেষ পর্যন্ত নারীবাদ নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই কল্যাণকর হবে? 

ঠিক তাই। নারীবাদীরা সকল প্রকার অসমতা, কর্তৃত্ব এবং নির্যাতন বিলোপ করার মাধ্যমে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং পারিবারিক ক্ষেত্রে নয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও একটি ন্যায্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই নতুন ব্যবস্থায় অনিবার্যভাবে পুরুষরাও অন্তর্ভুক্ত হবে। এই ব্যবস্থার ফলে অবশ্যই তারা কিছু কিছু সামাজিক সুবিধা হারাবে— তবে অন্যভাবে তারা লাভবান হবে, সমাজও লাভবান হবে। 

যেমন, যদি পরিবারের প্রত্যেক শিশুকে (শুধু ছেলে শিশু নয়) একইভাবে বড় করা হয় এবং তাদের উন্নতির জন্য একই ধরণের সুবিধা এবং উৎসাহ প্রদান করা হয়, তবে পরিবার এবং সমাজ উভয় স্থানেই আরও বেশি প্রতিভা বিকশিত হবে এবং সৃজনশীলতা বাড়বে। যদি নারীদের জোরপূর্বক নির্ভরশীল, অসহায়, অন্যের মুখাপেক্ষী করে রাখা না হয় তবে পরিবারগুলো আরও সম্ভাবনাময়, অর্থনৈতিকভাবে আরও মজবুত এবং সকল দিক থেকেই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। 

এই নতুন সমাজে পুরুষদের অর্থনৈতক দায়-দায়িত্ব এবং চাপও কম হবে এবং তারা আরও সহজভাবে তাদের নিজস্ব আশা আকাঙ্ক্ষাগুলো প্রকাশ করতে পারবে। যে কাজগুলো তথাকথিতভাবে ‘মেয়েলি’ বলে বিবেচিত, তারাও সে কাজ করতে পারবে এবং চাইলেই ঘরে বসে থাকতে পারবে। পুরুষরা যা বর্তমানে নারীসুলভ গুণাবলি হিসেবে বিবেচিত সেগুলোর অনুশীলন করতে পারবে। নানাবিধ জীবনদায়ী কার্যকলাপ যা থেকে এখন পুরুষ বঞ্চিত তাতে তাদের প্রবেশাধিকার ঘটবে। বর্তমান সমাজ পুরুষদের কাছ থেকে যে ভূমিকা ও ভাবমূর্তি দাবি করে নারীবাদ তাদের তা থেকে মুক্ত করে দিত। পুরুশ ও নারী উভয়ই তাদের প্রকৃত স্বভাব বুঝতে সক্ষম হবে। 

নারীবাদীদের উদ্দেশ্য বর্তমান ব্যবস্থায় অর্ধেক স্থান নারীদের দ্বারা পূর্ণ করা নয়, বর্তমান অসম এবং অন্যায্য  ক্ষমতা কাঠামোতে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব অর্জন করা নয় বরং সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন নিশ্চিত করা। 

এছাড়াও, আমাদের মতে নারীবাদ বলতে কেবল নারী কর্তৃক পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ধ্যানধারণা গ্রহণ করা, উপযোগী করা এবং অবলম্বন করাকে বুঝায় না বরং প্রত্যেকটা বিষয়ে পুনঃপর্যালোচনা এবং পুনর্মূল্যায়ন বুঝায়। অন্য কথায়, নারীদের পুরুষদের মতো হয়ে যাওয়াটা নারীবাদ নয়। একটি বিকল্প সংস্কৃতি  তৈরির ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষ উভয়ের প্তহের ভেতরে কোনটা ভালো তা অনুসন্ধান করাই নারীবাদের কাজ। 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।