টিভি খুব কম দেখা হয়। দেখলেও মূলত নিউজ। নিউজের সময়ই সেদিন দেখলাম এক যুবক মলম দিয়ে বুকের লোম তুলছেন। জানলাম, তিনি বুকের ‘অবাঞ্ছিত লোম’ তুলছেন। শরীরে অনেক লোম থাকায় তিনি নিজেকে যথেষ্ট আবেদনময় ভাবছিলেন না। তাই কাঙ্ক্ষিত রমনীর কাছে যেতে তিনি কুন্ঠিত। বুকের ‘অবাঞ্ছিত লোম’ তুলে ফেলে যুবকটি আত্মবিশ্বাসী হয় এবং আকাঙ্ক্ষার নারীকে বহুবন্দী করে হাসে।
বুকের অযাচিত লোম
বিজ্ঞাপনটি দেখে যুগপৎভাবে দুটো অনুভুতি হয়েছে। হায়! বুকের অযাচিত লোম এই ভেবে হাসি লেগেছে। অন্যদিকে মনে হয়েছে, বিউটি বা সৌন্দর্য বিষয়ে সমাজের প্রচলিত ধারণা বদলাচ্ছে। বিজ্ঞাপনটি তারই প্রমাণ। মানবশরীরের লোমের প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক এই বস্তুকেই নারীদের জন্য সৌন্দর্যের পথে বাঁধা হিসেবে তুলে ধরা হয়। ফলে চোখের ভ্রু থেকে শুরু করে হাত-পায়ের লোম তোলার চর্চা দুনিয়াব্যাপী চলছে। লোম তোলা ইন্ডাস্ট্রির বিশ্ব-অর্থনীতিও বিরাট। বিউটি ইন্ডাস্ট্রি তথা চোখের আরাম লাগার সংস্কৃতির একটি রাজনৈতিক দিকও আছে।
যুগ যুগ ধরে নারীকেই পুরুষের চোখের মাপে কোমনীয় ও আকর্ষণীয় হতে হয়েছে। কারণ সমাজের সকল কিছুতে পুরুষই ছিলো সক্রিয় ভূমিকায়। পুরুষই সিদ্ধান্তপ্রণেতা। আদর্শ নারীর গুণ, গজ ফিতায় মেপে নারীর দেহ-সৌষ্ঠব, রূপসী-গুণবতীর আনত থাকার আবশ্যকতা বিষয়ে মান-নির্ধারণকারী ছিলো পুরুষ। পুরুষের নিজের রুপ-গুণের নির্ধারকও সে-ই। অর্থাৎ পুরুষই মুখ্য। নারী উহ্য। তবে দুনিয়া পাল্টাচ্ছে। নানামুখী ঘটনার ঘাতে নারী-পুরুষের রূপ-সৌন্দর্য ও আবেদনময়তার মাপকাঠি বদলাচ্ছে।
পুরুষের বুকের লোম তোয়া নিয়ে আজকে হয়তো অনেকেই হাসতে পারেন। তাদের কাছে বুকের লোমকে ‘অযাচিত’ ভাবাটাই অদ্ভুত ঠেকতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটির মধ্যে রয়েছে সমাজ বদলের ইশারা। কারণ এই বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠা করছে যে সৌন্দর্য এখন পুরুষেরও গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড হয়ে উঠেছে। তাই পুরুষ নিজের শারীরিক উপস্থাপন নিয়ে ভাবছে। বিশ্বব্যাপী নারীরা কর্মে যুক্ত হচ্ছেন। নিজেদের প্রেম-বিয়ে-পছন্দ-অপছন্দ-যৌনতা নিয়ে স্পষ্টভাবে বলছেন। ফলে বিত্তশালী বা ক্ষমতাবান হলেই এখন পুরুষের চলছে না। পুরুষের ‘লুক’ বা তার সৌন্দর্যও প্রয়োজন হচ্ছে।
চাই লম্বা পাত্র, পাত্রের মাথাভরা চুল
আমার পরিচিত এক অবিবাহিত তরুণীর কথা বলি। তার পরিবার পাত্র খুঁজছে। তবে তিনি আগেই জানিয়েছেন, টাকওয়ালা পাত্র আবেদনের অযোগ্য হবেন। এ ছাড়া পাত্র হওয়াও আবশ্যক। হঠাৎ করে এমন শুনতে একটু ধাক্কা লাগে, তাই না? কিন্তু কনের জন্য কি সমাজটা আজও এ রকম নয়? যুগ যুগ ধরে পাত্রপক্ষ খুঁজেছে কনের দুধে আলতা গায়ের রং, দীঘল কালো কেশ এবং ইত্যাকার নানা কিছু। কিন্তু কনের চাওয়া কেউ জানতে চায়নি। জিজ্ঞাসার এই সংস্কৃতিই ছিল না। সমাজ মনে করতো, পাত্র যদি ভালো আয়-রোজগার করতে পারে, বউকে যদি শাড়ি-গয়না দিয়ে সুখে রাখতে পারে, তবেই হলো। এই মনোজগতেই তৈরি হয়েছে প্রবাদ, পুরুষ হচ্ছে সোনার আংটি।
আজকাল অনেক নারী নিজের ভাত-কাপড় নিজেই কামাই করছেন। অর্থ-স্বাধীন নারীরা পুরুষের সৌন্দর্য ও আবেদনময়তার চিরায়ত বয়ানকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছেন। ‘সোনার আংটি বাঁকাও ভালো’ বলে একটি প্রবাদ আছে। যার অর্থ পুরুষের চরিত্রে যদি একটু খুঁত বা দাগও থাকে, তবুও তার মর্যাদা বা কদর কমে যায় না। কিন্তু দুনিয়া কাঁপানো মি টু মুভমেন্ট এসে সেখানেও আঘাত করেছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে অনুচ্চারে একাধারে দুটি কাজ হয়েছে। একদিকে চরিত্রহীন পুরুষেরা নিজেদেরকে চরিত্রবান প্রমাণ করার পরোক্ষ চাপ বোধ করবে। অন্যদিকে পুরুষের এই চাপবোধ করার বাস্তবতার কারণেই নারীরা আরো সক্রিয় রূপে আবির্ভূত হবেন।
গ্রন্থিল বাহু বনাম পুরুষের কোমল কান্তি
সক্রিয় নারী সক্রিয় ভোক্তাও বটে। ফিল্ম বা মিউজিক ভিডিওগুলোতে আগে সাধারণত নারীকেই উপভোগ্য, কমনীয় বা দেখনসুখের বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হতো। সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোতে দেখবেন নায়কদের দেহসৌষ্ঠবের সতর্ক উপস্থাপন রয়েছে। পুরুষের সিক্স প্যাক দেখিয়ে পরিচালক শুধু পুরুষ দর্শকই ধরতে চান না। বরং নারীদেরও বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতে চান। সঞ্জয় লীলা বানসালি ‘সাভারিয়া’ ফিল্মে রণবীর কাপুরের তোয়ালে পরা নাচটা খেয়াল আছে? শরীরের খাঁজ-ভাঁজ দেখানোর নাচটির উদ্দিষ্ট দর্শক কি শুধুই পুরুষ? মোটেও না। নারীরাও এই নাচ চানাচুরের মতো খেয়েছেন।
ক্যাপিটালিজমের ঈশ্বরের নাম মুনাফা। মুনাফা অর্জনের জন্য বেনিয়ারা সব পারে। বেনিয়ার হিসাবে হিজাব পরিহিতা জন্য হিজাব রিফ্রেশ শ্যাম্পু থেকে সৌন্দর্য আমার অধিকার— সবই জায়েজ। মুনাফার প্রয়োজনে বণিকেরা নারীর ক্লিভেজ দেখিয়ে পুরুষদের কাত করবে আর নারীদের কাত করতে বাজারে আনবে মোহনীয় সৌষ্ঠবের পুরুষ। প্রশস্ত উদোম বুক, সিক্স প্যাক শরীর, গ্রন্থিল পেশি দেখে নারী দর্শকরা ভক্ত হবে। বেনিয়ারা সবার জন্য ‘অপশন’ বা বেছে নেবার স্বাধীনতা রাখতে চায়। এই বাজারে কোনো নারী রাফ এন্ড টাফ লুক, শক্ত চোয়ালের পোড়খাওয়া চেহারার নায়ক বেছে নেবেন। কোনো নারী বেছে নেবে রনবীরের লাল ঠোঁট। কোমল-কমনীয় চেহারা নিয়ে রণবীরের চোখ মেরে দেওয়ার দৃশ্য এবং তার তোয়ালে খোলা নাচ দেখে কত নারী সম্মোহিত হয়ে স্ক্রিনে তাকিয়েছিলো তার ইয়ত্তা আছে?
নিজের কথাই বলি। বয়স তখন আড়ও বছর দশ-বারো কম। তখন আমি ব্র্যাড পিটের পাগল ভক্ত। পিটের অনেক সিনেমায় শুধু তার অংশগুলো ৫/৭/১০ বারও দেখা হয়েছে। ট্রয়, রিভার রান্স থ্রু ইট, মি জো ব্ল্যাক, লিজেন্ডস অফ দি ফল, কিউরিয়াস কেস অব বেঞ্জামিন বাটন, সিনেমাগুলোতে পিটকেই গিলতাম। এমনকি তার সাম্প্রতিক সিনেমা ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন হলিউড- এ ব্র্যাড পিট যখন গল্পের এক পর্যায়ে শার্ট খুলে উদোম গায়ে বাড়ির চালে উঠে এন্টেনা ঠিকঠাক করছিলো, সেই দুশ্যও চুম্বকীয়। কাজের ফাকে বিরতি দিয়ে পিট সিগারেট ধরায়। সে সময় ক্লোজ আপে তার মুখ পর্দায় ভেসে ওঠে। পঞ্চাশোর্ধ সেই পোড়খাওয়া চেহারার আবেদনও ‘মারডালা’। বাড়ির চালে তুলে ব্র্যাড পিটকে দিয়ে পরিচালক এমনি এমনি কাপড় খোলাননি। কর্তারা জানেন, পিটের বুকে থাকা কচি কচি ঘাসের মতো লোম, তার ঘন লালচে চুল, তার লম্বা গড়ন, প্রশস্ত বুকের ছাতি, পোড়খাওয়া ড্যাম কেয়ার ভাবের চেহারা দেখতে দেখতে ভক্তরা মুখিয়ে আছে।
সৌন্দর্য বেঁচে পয়সা কামানোর এমন মওকা বেনিয়ারা হাতছাড়া করবে না। তাই নারীর শরীরের মতোই পুরুষের শরীরের পণ্যায়নও এখন বেশি মাত্রায় গোচরে আসবে। মানুষের পণ্যায়ন করা ঠিক না বেঠিক, সেটি ভিন্ন বিতর্ক। সেটি অন্য দিনের জন্য তোলা থাকুক। বক্ষ্যমান লেখায় এটুকু বলে শেষ করতে চাই যে পুরুষরাও এখন সৌন্দর্য বিতানে ছুটছেন। ক্যাপিটালিজমের নারীর পায়ের লোম উঠানোকে শুধু গ্রহণযোগ্যতাই দেয়নি বরং এক প্রকারের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা পরিণত করেছে। পশ্চিমের দেশগুলোতে এমনকি সুইমিং পুলে যাবার আগেও অনেক নারীই হাত-পায়ের লোম উঠানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। এই তালিকায় যোগ হয়েছে পুরুষের বুকের লোম। সৌন্দর্যভাবনায় নয়া নির্মিতি বটে।

কোনো পুরুষের বুকে লোম না থাকলে সেই পুরুষের বুককে আমাদের গ্রামদেশে সীমারের বুকের সাথে তুলনা করতো। লোমহীন বুকের পুরুষকে ভাবা হতো পাষাণ, নির্দয়। আর বুকে ঘন লোম মানে হৃদয়ে অধিক মায়া। কিন্তু চিন্তা পাল্টাচ্ছে। এখন বুকে অনেক লোম থাকা পুরুষের মনে অস্বস্তি উৎপাদন করে মলম বিক্রি করতে চায় বেনিয়ারা। পুরুষের এই অস্বস্তি আসলে সমাজের রক্ষণশীলতা ভাঙারও আভাস।
বুকের লোমের সাথে দয়া-মায়ার সম্পর্ক আছে কিনা জানি না। তবে ক্যাপিটালিজমের বুকে কোনো দয়া-মায়া নেই। বেনিয়ারা মুনাফায় রাশ টানতে জানে না। তাই নারীর হাত-পায়ের লোমের মতোই এখন পুরুষের বুকের লোমও পেয়েছে ‘অযাচিত’ তকমা। এই দুই ধরণের ‘অযাচিত’ লোম মিলে আমার হিসেবে দুটি ‘যাচিত’ ব্যাপার ঘটেছে। প্রথম যাচিত বিষয়টি হচ্ছে, নারী ও পুরুষের মধ্য পণ্যায়নের একটা বিশেষ ঐক্য। যদি পুরুষের বুকের লোম তোলাটাকে মানুষ হাস্যকর অদরকারী মনে করে, তাহলে নারীর লোম তোলা নিয়ে প্রশ্নের জোরও বাড়বে।
দ্বিতীয় যাচিত বিষয়টি হচ্ছে, পুরুষেরা যতই কামাই করুক না কেন, নারীর মনের মতো হতে গিয়ে এখন তাকে মাখতে হচ্ছে রং ফর্সাকারী ক্রিম, তুলতে হচ্ছে বুকের লোম, করতে হচ্ছে চুলের যত্ম, রূপচচা করার জন্য যেতে হচ্ছে সৌন্দর্যবিতানে। বিউটি ইন্ডাস্ট্রি বলতেই এখন আপনি শুধু নারীকে বুঝবেন না। বরং এখানে পুরুষ ও ট্রান্সজেন্ডারও অন্তর্ভুক্ত হয়। তাছাড়া ভিটের এই বিজ্ঞাপনের ভেতর দিয়ে অলক্ষ্যেই নারীর পছন্দও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কচি ঘাসে ছাওয়া প্রান্তর নাকি মসৃণ-পেলবতা? এই প্রশ্নের ভেতর দিয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে পুরুষের সৌন্দর্যে। লক্ষ্য করুন, পুরুষের শৌর্য-বীর্য নয়, সৌন্দর্য। সময় আসছে যখন শুধু নারীর সৌন্দর্য নয়, বরং তার সাহস-বীরত্ব নিয়ে বেশি কথা হবে। রক্ষণশীল সমাজে এটা বড় বদল।