পুরুষের সৌন্দর্য, নারীর চোখে  

afroja soma
আফরোজা সোমা

টিভি খুব কম দেখা হয়। দেখলেও মূলত নিউজ। নিউজের সময়ই সেদিন দেখলাম এক যুবক মলম দিয়ে বুকের লোম তুলছেন। জানলাম, তিনি বুকের ‘অবাঞ্ছিত লোম’ তুলছেন। শরীরে অনেক লোম থাকায় তিনি নিজেকে যথেষ্ট আবেদনময় ভাবছিলেন না। তাই কাঙ্ক্ষিত রমনীর কাছে যেতে তিনি কুন্ঠিত। বুকের  ‘অবাঞ্ছিত লোম’ তুলে ফেলে যুবকটি আত্মবিশ্বাসী হয় এবং আকাঙ্ক্ষার নারীকে বহুবন্দী করে হাসে। 

বুকের অযাচিত লোম

বিজ্ঞাপনটি দেখে যুগপৎভাবে দুটো অনুভুতি হয়েছে। হায়! বুকের অযাচিত লোম এই ভেবে হাসি লেগেছে। অন্যদিকে মনে হয়েছে, বিউটি বা সৌন্দর্য বিষয়ে সমাজের প্রচলিত ধারণা বদলাচ্ছে। বিজ্ঞাপনটি তারই প্রমাণ। মানবশরীরের লোমের প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক এই বস্তুকেই নারীদের জন্য সৌন্দর্যের পথে বাঁধা হিসেবে তুলে ধরা হয়। ফলে চোখের ভ্রু থেকে শুরু করে হাত-পায়ের লোম তোলার চর্চা দুনিয়াব্যাপী চলছে। লোম তোলা ইন্ডাস্ট্রির বিশ্ব-অর্থনীতিও বিরাট। বিউটি ইন্ডাস্ট্রি তথা চোখের আরাম লাগার সংস্কৃতির একটি রাজনৈতিক দিকও আছে। 

যুগ যুগ ধরে নারীকেই পুরুষের চোখের মাপে কোমনীয় ও আকর্ষণীয় হতে হয়েছে। কারণ সমাজের সকল কিছুতে পুরুষই ছিলো সক্রিয় ভূমিকায়। পুরুষই সিদ্ধান্তপ্রণেতা। আদর্শ নারীর গুণ, গজ ফিতায় মেপে নারীর দেহ-সৌষ্ঠব, রূপসী-গুণবতীর আনত থাকার আবশ্যকতা বিষয়ে মান-নির্ধারণকারী ছিলো পুরুষ। পুরুষের নিজের রুপ-গুণের নির্ধারকও সে-ই। অর্থাৎ পুরুষই মুখ্য। নারী উহ্য। তবে দুনিয়া পাল্টাচ্ছে। নানামুখী ঘটনার ঘাতে নারী-পুরুষের রূপ-সৌন্দর্য ও আবেদনময়তার মাপকাঠি বদলাচ্ছে। 

পুরুষের বুকের লোম তোয়া নিয়ে আজকে হয়তো অনেকেই হাসতে পারেন। তাদের কাছে বুকের লোমকে ‘অযাচিত’ ভাবাটাই অদ্ভুত ঠেকতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটির মধ্যে রয়েছে সমাজ বদলের ইশারা। কারণ এই বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠা করছে যে সৌন্দর্য এখন পুরুষেরও গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড হয়ে উঠেছে। তাই পুরুষ নিজের শারীরিক উপস্থাপন নিয়ে ভাবছে। বিশ্বব্যাপী নারীরা কর্মে যুক্ত হচ্ছেন। নিজেদের প্রেম-বিয়ে-পছন্দ-অপছন্দ-যৌনতা নিয়ে স্পষ্টভাবে বলছেন। ফলে বিত্তশালী বা ক্ষমতাবান হলেই এখন পুরুষের চলছে না। পুরুষের ‘লুক’ বা তার সৌন্দর্যও প্রয়োজন হচ্ছে।  

চাই লম্বা পাত্র, পাত্রের মাথাভরা চুল

আমার পরিচিত এক অবিবাহিত তরুণীর কথা বলি। তার পরিবার পাত্র খুঁজছে। তবে তিনি আগেই জানিয়েছেন, টাকওয়ালা পাত্র আবেদনের অযোগ্য হবেন। এ ছাড়া পাত্র হওয়াও আবশ্যক। হঠাৎ করে এমন শুনতে একটু ধাক্কা লাগে, তাই না? কিন্তু কনের জন্য কি সমাজটা আজও  এ রকম নয়? যুগ যুগ ধরে পাত্রপক্ষ খুঁজেছে কনের দুধে আলতা গায়ের রং, দীঘল কালো কেশ এবং ইত্যাকার নানা কিছু। কিন্তু কনের চাওয়া কেউ জানতে চায়নি। জিজ্ঞাসার এই সংস্কৃতিই ছিল না। সমাজ মনে করতো, পাত্র যদি ভালো আয়-রোজগার করতে পারে, বউকে যদি শাড়ি-গয়না দিয়ে সুখে রাখতে পারে, তবেই হলো। এই মনোজগতেই তৈরি হয়েছে প্রবাদ, পুরুষ হচ্ছে সোনার আংটি। 

আজকাল অনেক নারী নিজের ভাত-কাপড় নিজেই কামাই করছেন। অর্থ-স্বাধীন নারীরা পুরুষের সৌন্দর্য ও আবেদনময়তার চিরায়ত বয়ানকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছেন। ‘সোনার আংটি বাঁকাও ভালো’ বলে একটি প্রবাদ আছে। যার অর্থ পুরুষের চরিত্রে যদি একটু খুঁত বা দাগও থাকে, তবুও তার মর্যাদা বা কদর কমে যায় না। কিন্তু দুনিয়া কাঁপানো মি টু মুভমেন্ট এসে সেখানেও আঘাত করেছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে অনুচ্চারে একাধারে দুটি কাজ  হয়েছে। একদিকে চরিত্রহীন পুরুষেরা নিজেদেরকে চরিত্রবান প্রমাণ করার পরোক্ষ চাপ বোধ করবে। অন্যদিকে পুরুষের এই চাপবোধ করার বাস্তবতার কারণেই নারীরা আরো সক্রিয় রূপে আবির্ভূত হবেন। 

গ্রন্থিল বাহু বনাম পুরুষের কোমল কান্তি

সক্রিয় নারী সক্রিয় ভোক্তাও বটে। ফিল্ম বা মিউজিক ভিডিওগুলোতে আগে সাধারণত নারীকেই উপভোগ্য, কমনীয় বা দেখনসুখের বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হতো। সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোতে দেখবেন নায়কদের দেহসৌষ্ঠবের সতর্ক উপস্থাপন রয়েছে। পুরুষের সিক্স প্যাক দেখিয়ে পরিচালক শুধু পুরুষ দর্শকই ধরতে চান না। বরং নারীদেরও বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতে চান। সঞ্জয় লীলা বানসালি ‘সাভারিয়া’ ফিল্মে রণবীর কাপুরের তোয়ালে পরা নাচটা খেয়াল আছে? শরীরের খাঁজ-ভাঁজ দেখানোর নাচটির উদ্দিষ্ট দর্শক কি শুধুই পুরুষ? মোটেও না। নারীরাও এই নাচ চানাচুরের মতো খেয়েছেন।  

ক্যাপিটালিজমের ঈশ্বরের নাম মুনাফা। মুনাফা অর্জনের জন্য বেনিয়ারা সব পারে। বেনিয়ার হিসাবে হিজাব পরিহিতা জন্য হিজাব রিফ্রেশ শ্যাম্পু থেকে সৌন্দর্য আমার অধিকার— সবই জায়েজ। মুনাফার প্রয়োজনে বণিকেরা নারীর ক্লিভেজ দেখিয়ে পুরুষদের কাত করবে আর নারীদের কাত করতে বাজারে আনবে মোহনীয় সৌষ্ঠবের পুরুষ। প্রশস্ত উদোম বুক, সিক্স প্যাক শরীর, গ্রন্থিল পেশি দেখে নারী দর্শকরা ভক্ত হবে। বেনিয়ারা সবার জন্য ‘অপশন’ বা বেছে নেবার স্বাধীনতা রাখতে চায়। এই বাজারে কোনো নারী রাফ এন্ড টাফ লুক, শক্ত চোয়ালের পোড়খাওয়া চেহারার নায়ক বেছে নেবেন। কোনো নারী বেছে নেবে রনবীরের লাল ঠোঁট। কোমল-কমনীয় চেহারা নিয়ে রণবীরের চোখ মেরে দেওয়ার দৃশ্য এবং তার তোয়ালে খোলা নাচ দেখে কত নারী সম্মোহিত হয়ে স্ক্রিনে তাকিয়েছিলো তার ইয়ত্তা আছে?

নিজের কথাই বলি। বয়স তখন আড়ও বছর দশ-বারো কম। তখন আমি ব্র্যাড পিটের পাগল ভক্ত। পিটের অনেক সিনেমায় শুধু তার অংশগুলো ৫/৭/১০ বারও দেখা হয়েছে। ট্রয়, রিভার রান্স থ্রু ইট, মি জো ব্ল্যাক, লিজেন্ডস অফ দি ফল, কিউরিয়াস কেস অব বেঞ্জামিন বাটন, সিনেমাগুলোতে পিটকেই গিলতাম। এমনকি তার সাম্প্রতিক সিনেমা ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন হলিউড- এ ব্র‍্যাড পিট যখন গল্পের এক পর্যায়ে শার্ট খুলে উদোম গায়ে বাড়ির চালে উঠে এন্টেনা ঠিকঠাক করছিলো, সেই দুশ্যও চুম্বকীয়। কাজের ফাকে বিরতি দিয়ে পিট সিগারেট ধরায়। সে সময় ক্লোজ আপে তার মুখ পর্দায় ভেসে ওঠে। পঞ্চাশোর্ধ সেই পোড়খাওয়া চেহারার আবেদনও ‘মারডালা’। বাড়ির চালে তুলে ব্র্যাড পিটকে দিয়ে পরিচালক এমনি এমনি কাপড় খোলাননি। কর্তারা জানেন, পিটের বুকে থাকা কচি কচি ঘাসের মতো লোম, তার ঘন লালচে চুল, তার লম্বা গড়ন, প্রশস্ত বুকের ছাতি, পোড়খাওয়া ড্যাম কেয়ার ভাবের চেহারা দেখতে দেখতে ভক্তরা মুখিয়ে আছে।  

সৌন্দর্য বেঁচে পয়সা কামানোর এমন মওকা বেনিয়ারা হাতছাড়া করবে না। তাই নারীর শরীরের মতোই পুরুষের শরীরের পণ্যায়নও এখন বেশি মাত্রায় গোচরে আসবে। মানুষের পণ্যায়ন করা ঠিক না বেঠিক, সেটি ভিন্ন বিতর্ক। সেটি অন্য দিনের জন্য তোলা থাকুক। বক্ষ্যমান লেখায় এটুকু বলে শেষ করতে চাই যে পুরুষরাও এখন সৌন্দর্য বিতানে ছুটছেন। ক্যাপিটালিজমের নারীর পায়ের লোম উঠানোকে শুধু গ্রহণযোগ্যতাই দেয়নি বরং এক প্রকারের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা পরিণত করেছে। পশ্চিমের দেশগুলোতে এমনকি সুইমিং পুলে যাবার আগেও অনেক নারীই হাত-পায়ের লোম উঠানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। এই তালিকায় যোগ হয়েছে পুরুষের বুকের লোম। সৌন্দর্যভাবনায় নয়া নির্মিতি বটে। 

কোনো পুরুষের বুকে লোম না থাকলে সেই পুরুষের বুককে আমাদের গ্রামদেশে সীমারের বুকের সাথে তুলনা করতো। লোমহীন বুকের পুরুষকে ভাবা হতো পাষাণ, নির্দয়। আর বুকে ঘন লোম মানে হৃদয়ে অধিক মায়া। কিন্তু চিন্তা পাল্টাচ্ছে। এখন বুকে অনেক লোম থাকা পুরুষের মনে অস্বস্তি উৎপাদন করে মলম বিক্রি করতে চায় বেনিয়ারা। পুরুষের এই অস্বস্তি আসলে সমাজের রক্ষণশীলতা ভাঙারও আভাস। 

বুকের লোমের সাথে দয়া-মায়ার সম্পর্ক আছে কিনা জানি না। তবে ক্যাপিটালিজমের বুকে কোনো দয়া-মায়া নেই। বেনিয়ারা মুনাফায় রাশ টানতে জানে না। তাই নারীর হাত-পায়ের লোমের মতোই এখন পুরুষের বুকের লোমও পেয়েছে ‘অযাচিত’ তকমা। এই দুই ধরণের ‘অযাচিত’ লোম মিলে আমার হিসেবে দুটি ‘যাচিত’ ব্যাপার ঘটেছে। প্রথম যাচিত বিষয়টি হচ্ছে, নারী ও পুরুষের মধ্য পণ্যায়নের একটা বিশেষ ঐক্য। যদি পুরুষের বুকের লোম তোলাটাকে মানুষ হাস্যকর অদরকারী মনে করে, তাহলে নারীর লোম তোলা নিয়ে প্রশ্নের জোরও বাড়বে।   

দ্বিতীয় যাচিত বিষয়টি হচ্ছে, পুরুষেরা যতই কামাই করুক না কেন, নারীর মনের মতো হতে গিয়ে এখন তাকে মাখতে হচ্ছে রং ফর্সাকারী ক্রিম, তুলতে হচ্ছে বুকের লোম, করতে হচ্ছে চুলের যত্ম, রূপচচা করার জন্য যেতে হচ্ছে সৌন্দর্যবিতানে। বিউটি ইন্ডাস্ট্রি বলতেই এখন আপনি শুধু নারীকে বুঝবেন না। বরং এখানে পুরুষ ও ট্রান্সজেন্ডারও অন্তর্ভুক্ত হয়। তাছাড়া ভিটের এই বিজ্ঞাপনের ভেতর দিয়ে অলক্ষ্যেই নারীর পছন্দও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কচি ঘাসে ছাওয়া প্রান্তর নাকি মসৃণ-পেলবতা? এই প্রশ্নের ভেতর দিয়ে  মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে পুরুষের সৌন্দর্যে। লক্ষ্য করুন, পুরুষের শৌর্য-বীর্য নয়, সৌন্দর্য। সময় আসছে যখন শুধু নারীর সৌন্দর্য নয়, বরং তার সাহস-বীরত্ব নিয়ে বেশি কথা হবে। রক্ষণশীল সমাজে এটা বড় বদল। 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।