সুকুমারী_ভট্টাচার্য
সুকুমারী ভট্টাচার্য

বংশ মানে বাঁশ, প্রকৃতির বাঁশে একটু দূরে গাঁট বা কস্তিকা থাকে, এতে বাঁশটির বয়স বোঝা যায়। মানুষের চেতনায় এ গ্রন্থিগুলি সম্ভবত প্রজন্মের চিহ্ন বহন করে। পুরো বংশ একটা অবিচ্ছিন্ন দীর্ঘ ধারার প্রতীক। বংশের কল্পনাই এই কোনও এক প্রখ্যাত (কখনও বা অখ্যাত) আদিপুরুষের (আদিনারীর কথা খুব কমই শ্রুত হয়) থেকে শুরু করে অবিচ্ছিন্ন অব্যাহত একটা পরম্পরা; এবং সারা পৃথিবীতেই এটা একটা বিশিষ্ট পরিচয়। এই ধরনের পরিচয়ের জন্যে মানবচিত্তে যে আকাঙ্ক্ষা তার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে, ব্যক্তিমানুষ সদাই মৃত্যুভয়ে ত্রস্ত শঙ্কিত। সন্তানের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের সূচনা এবং প্রজন্ম পরম্পরার মধ্য দিয়ে গৌণ ভাবে হলেও ওই আদিপুরুষ বা তার উত্তরাধিকারী যেন ওই ধারার মধ্য দিয়ে জীবিত থাকে। এ এক ধরনের অমরতা — মননে, কল্পনায় মৃত্যুকে জয় করা। মৃত্যুর পূর্বে মানুষটি জেনে যায় যে, ব্যক্তিপুরুষের সঙ্গে সঙ্গে তার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটবে না। এইখানেই বংশ, বংশরক্ষা বংশের ধারা, ইত্যাদির যেন একটা তত্ত্বগত সমর্থন মেলে। বংশপরম্পরা এক প্রজন্মপুরুষের মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকবে। এটি একটি পরম আশ্বাস। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মৃত বংশকর্তা এক ভাবে নিজেকে প্রসারিত করে এবং সেই কারণেই এক বিদেহ সত্তায় বর্তমান থাকে বলে অনুভব করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঊর্ধ্বতন দু-তিনপুরুষের বেশি স্মৃতিচিন্তাতেও বিধৃত নয়, অথচ আর্যদের মধ্যে এই বোধ প্রবল ভাবে বিদ্যমান। সম্ভবত আগন্তুক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আর্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাগার্যদের মধ্যে বসবাস করেও তারা, আর্যরা, যে স্বতন্ত্র একটি জনগোষ্ঠী এবং তারা যে নানা কারণে বিশিষ্ট ও উন্নততর এ কথা স্মরণে রাখবার জন্যে এবং প্রতিবেশীদের কাছে এর স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যেই সৃষ্টি হয় বংশপরিচয়। এতে আর্যদের একটা আত্মপরিচয় যেন নিহিত ছিল। বংশকর আদিপুরুষের পরে খ্যাতিমান বংশধর থেকে গোত্র এবং তারও পরে পরপ্রজন্মের উজ্জ্বল ব্যক্তি প্রবর নামে খ্যাত হতেন। এঁরা সকলেই বংশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতেন বলেই পরপ্রজন্মের কাছে সম্মানিত হতেন। এ সব বিভাগের দ্বারা আর্যদের বংশ আরও সুপরিচিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হত।

এখনও কথায় কথায় লোকে বংশের সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে ‘চোদ্দপুরুষ’ বলে থাকে— অর্থাৎ বংশ পরিচয়কে সুদীর্ঘ অতীতে বিস্তারিত করবার চেষ্টা। ক্রিয়াকর্মে ঊর্ধ্বতন তিনপুরুষের নাম উল্লেখ করে অনুষ্ঠান করা হয়, আর তারও পূর্বের পুরুষদের নাম উল্লেখ না করে তর্পণ করা হয়। লোকে নিজেদের বংশ কত প্রাচীন তা নিয়ে গর্ব করে থাকে। প্রাগার্য পরিবেষ্টিত আর্যদের বংশ পরিচয় ছিল গর্বের উপাদান। যার যত দীর্ঘ বংশতালিকা তার তত বেশি প্রতিষ্ঠা, তত গর্ব। ভিনদেশে এসে বসবাস করলে এটাই হয়তো নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও গর্ব করবার বিশেষ উপায় ছিল। একটা সময়ে যখন এ দেশে আর্য বসবাসের ইতিহাস হ্রস্ব ছিল তখন সমাজে বংশপরিচয়কে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হত। এখনও কোনও কোনও পরিবার তাদের গোত্র-প্রবরের পরিচয় দিয়ে বংশের দীর্ঘ তালিকা দিয়ে প্রাচীনত্ব প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করে। আর্যদের চেতনায় গোপন একটি বাসনা ছিল, এই উপায়ে তারা তাদের আগন্তুক সত্তাকে আড়াল করবে, এ দেশে বসবাসের দীর্ঘতা দিয়ে অভিবাসনের ইতিহাস গৌণ করে রাখবে। বংশ ও বংশপরিচয় তাই তখন এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার ছিল: ঋগ্‌বেদে দেখি প্রাগার্যদের প্রতি আর্যদের প্রবল একটা অবজ্ঞা; ওরা কৃষ্ণবর্ণ, হ্রস্বজঙ্ঘ। এই অবজ্ঞাত, প্রাগার্যদের সঙ্গে পাছে আর্যরা মিলে যায় এবং তার ফলে আর্যমহিমা ক্ষুণ্ণ হয় তাই বংশতালিকার দৈর্ঘ্য দিয়ে, গোত্র-প্রবরের পরিচয় দিয়ে আর্যদের স্বতন্ত্র মহিমাকে অমলিন রাখার একটা চেষ্টা বংশপরিচয় সম্বন্ধে সতর্ক প্রহরার মধ্যে দেখা যায়; অর্থাৎ আর্য-প্রগার্য মিশ্রবিবাহের ফলে বর্ণসংকর ঘটলে আর্যমহিমা ক্ষুণ্ণ হবে এই আশঙ্কাতেই নিজেদের বংশগৌরব সম্বন্ধে আর্যরা তীব্র ভাবে সচেতন ছিল; তাদের শ্রাদ্ধ, বিবাহ ইত্যাদি বহু শুভকর্মের সূচনাই হত ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের নামোল্লেখ করে। অর্থাৎ তারা যে বহুকাল ধরে এ দেশে বাস করছে— উটকো আগন্তুক নয়— এ সম্বন্ধে নিজেদের ও প্রাগার্যদের বিশেষ ভাবে সচেতন থাকতে হত। এতে আর্যদের আত্মপ্রত্যয় ও শ্লাঘা প্রশ্রয় পেত। প্রাগার্যদের মধ্যে বংশপরিচয় সংরক্ষণের কোনও রীতি ছিল না। আজও তাই বর্ণহিন্দুর বাইরে যারা, তারা বংশপরিচয় সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন বলেই তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাপের নাম এবং গ্রামের নামেই তাদের পরিচয়, এতেই তাদের চলে এসেছে এতাবৎকাল এবং আজও চলছে। অথচ এখনও মধ্যবিত্ত পরিবার যখন বংশগৌরব নিয়ে পরস্পরের মধ্যে কথা বলেন, তখন তাঁরা ভুলে যান যে বাড়ির পরিচারিকাটি ওই পরিচয়ে বঞ্চিত এবং সে জন্য সে কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ নয়।

আমরা সবাই জানি যে, এত সব বিধিনিষেধ সত্ত্বেও আজকের হিন্দু সমাজে আর্যরক্ত বহু ভিন্ন গোষ্ঠীর রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে চলেছিল দীর্ঘকাল ধরে; এই মিশ্রণ শুধু প্রাগার্যদের রক্তের সঙ্গে নয়, একে একে যত আগন্তুক জাতি আক্রমণকারী বা অন্য ভূমিকাতেও ভারতবর্ষে এসেছে এবং ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভাবে নিঃশেষে তাদের মধ্যে মিশে গেছে এ দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সকলের রক্ত মিশে আছে। ‘হিন্দুর’ রক্তে মিশে আছে পাঠান, মোগল, খ্রিস্টান, পারসি, পহ্লব, কুষাণ, শক, হূন, পারদ সকলেরই রক্ত। কাজেই বংশগৌরবের পূর্বে প্রাচীন আর্যসমাজে যে ভিত্তি ছিল, আজ তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এতে কিন্তু সমাজে যাঁরা বংশগৌরবে গর্বিত তাঁদের গর্বের মাত্রা কিছুই কমেনি। কারণ, এর সঙ্গে যুক্ত প্রাগার্য, প্রত্যন্তবাসী জনগোষ্ঠীর থেকে নিজেদের পার্থক্য ঘোষণা। বংশপরিচয়ে মর্যাদার তারতম্য জ্ঞাপন আবার বংশগর্বে গর্বিত ওপরতলার মানুষের নীচুতলার লোকদের থেকে নিজেদের পার্থক্য ও গৌরব ঘোষণা করার এক উপায়।

ঋগ্বেদের কাল থেকে ধীরে ধীরে বেদাঙ্গসূত্রের কাল পর্যন্ত বংশ, গোত্র, প্রবর ইত্যাদি এক ভাবে বেড়েই উঠেছিল ও ক্রমেই পল্লবিত হচ্ছিল। কিন্তু এর পরের যুগে খ্রিস্টীয় পঞ্চম ষষ্ঠ শতকে কি তার অল্প আগে থেকেই যে সব শাস্ত্র রচিত হচ্ছিল যার মধ্য দিয়ে ধর্মসূত্রের চিন্তাধারার প্রসার ঘটছিল— যেমন নিবন্ধ শাস্ত্রগুলি, স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণ— এ সবের মধ্যে বংশ গোত্র-প্রবর ইত্যাদি ক্রমেই বেশি প্রাধান্য পেতে থাকে। শুধু তাই নয়, এগুলির শাখা-প্রশাখার বিস্তার হয়ে চলে এবং নানা সামাজিক প্রভাবে ক্রমেই পল্লবিত হয় এবং ক্রমশ কঠিন দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ হয়; পরস্পরের মধ্যে সঞ্চরণ ক্রমেই বন্ধ হতে থাকে। ফলে সমাজে মানুষের পরিচয় তার পূর্বপুরুষের পরিচয়ের দ্বারাই নিরূপিত হয়। যার বংশমর্যাদা যত প্রাচীন ও যার গোত্র-প্রবর পরিচয় যত খ্যাতিমান, সমাজে তার আভিজাত্য তত বেশি। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে সংযুক্ত হল যার বংশ-গোত্র-প্রবর, ইত্যাদি পরিচয় নেই সেই প্রাগার্য বা সমাজের প্রত্যন্তবাসী আদিবাসী সম্প্রদায়— বংশপরিচয়হীন বলে সমাজে তার অবনমন। শুধু তাই নয়, যাদের বংশ পরিচয় আছে, তারাও সেই পরিচয়ে সকলে সমান নয় বলে সমাজে এই হিসাবে উঁচুনীচু ভেদ বাড়ল। যে বংশপরিচয়ে যত দীন সে অভিজাত সম্প্রদায় থেকে তত নীচে সরে যেতে থাকল। এই প্রক্রিয়া কয়েকশো বছর ধরে বেড়েই চলেছে এবং হিন্দুসমাজেই একটি বংশের ছোঁওয়া জল অন্য বংশ পান করবে না— ক্রমে এমন অমানবিক পরিণতিও দেখা দিল এবং কায়েম হয়ে রইল। এটা হল, সমাজের শতকরা নম্বই ভাগের কথা; বাকি দশ ভাগ বিগত দুই শতকের নানা মানবিক আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওই সব সংস্কারের জগদ্দল চাপ থেকে কতকটা মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু এখনও সমাজের মূলস্রোতে বংশপরিচয়ের প্রবল প্রতাপ বর্তমান।

আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত সমাজের লোকেদেরও প্রায়ই বলতে শোনা যায় ‘কত বড় বংশ তা দেখতে হবে তো?’ কিংবা, ‘অমন ছোটবংশের লোকের কাছে আর কী-ই বা আশা করা যায়?’ ‘সরাসরি প্রশ্ন করলে এঁরা স্বীকার করবেন যে, বংশ ইত্যাদির কোনও যথার্থ সামাজিক বা মানবিক ভিত্তি নেই। অর্থাৎ বংশপরিচয় ধীরে ধীরে আমাদের চেতনার অভ্যন্তরে স্থান করে নিয়েছে। জাতিভেদে যে শ্রেণিবিভাজন ঘটে তারই আনুষঙ্গিক এবং অনুরূপ একটি মারাত্মক বিভাজন ঘটে বংশপরিচয়ে। এটি আরও মারাত্মক এই কারণে যে, বহু শতক বা সহস্রাব্দ পূর্বের কোনও পূর্বপুরুষের পরিচয়ের সঙ্গে এটি সম্পৃক্ত, তা এত দূর অতীতের যে, একে কোনও ভাবে প্রভাবিত করার সাধ্য বর্তমান প্রজন্মের নেই; অতএব অমোঘ নিয়তির মতো এর দ্বারা নিরূপিত হয় বর্তমান প্রজন্মের পরিচয় এবং সে পরিচয়ের দ্বারা সমাজে তার স্থান নির্ণীত হয়। তথাকথিত উচ্চবংশের মানুষ যেমন বিনা আয়াসে সুদূর অতীতের বংশের কোনও পুরুষের পরিচয় আত্মসাৎ করে সমাজে মাথা তুলে থাকে এবং নীচের দিকের মানুষের উপরে প্রতিপত্তি ফলায়, তেমনই আজ তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের কোনও সাধ্য নেই দু-আড়াই হাজার বছর আগেকার পূর্বপুরুষের নীচ অবস্থানকে কোনও ভাবেই অতিক্রম করা। এতে এক দিকে যেমন মানুষের আপন যোগ্যতা ও কৃতিত্ব যথার্থ মর্যাদা পায় না, তেমনই সম্পূর্ণ অযোগ্য অপদার্থ মানুষও বহু পূর্বের কোনও বংশকর মানুষের কৃতিত্ব অনায়াসে আত্মসাৎ করে দাপিয়ে বেড়ায়। মানুষের যথাযথ ব্যক্তিপরিচয় এতে গৌণ হয়ে যায়; বহু পূর্বের ধার করা এক তাৎপর্যহীন পরিচয়ই হয়ে উঠেছে আজকের সমাজে তার পরিচয়ের গৌরব বা দৈন্যের হেতু। এর মধ্যে একটা কৃত্রিমতা আছে।

এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, শুধু বংশকৌলিন্যের চেয়ে অনেক বেশি গৌরবের বংশ ও বিত্তের সহাবস্থান। সমাজ বিত্তকে চিরদিনই বাড়তি খাতির করে এসেছে, এখনও করে। তবে বিত্ত না থাকলেও শুধু বংশমর্যাদার ওজন এখনও আছে। যদিও গত পঞ্চাশ বছর ধরে উল্টোটাও সত্যি, অর্থাৎ বংশগৌরবহীন নিছক বিত্তকৌলিন্যও এখন সমাজে অস্বাভাবিক এবং কুরুচিকর প্রাধান্য পায়।

বংশপরিচয় প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক; বংশকর পুরুষ, গোত্র ও প্রবরের প্রতিষ্ঠাতা সকলেই পুরুষ— শুধু এ দেশে নয়, অধিকাংশ দেশেই। কিছু কিছু আদিবাসী অঞ্চলে এবং দেশের কোনও কোনও মাতৃতান্ত্রিক অঞ্চলে মাতৃবংশের পরিচয়েও সন্তানের পরিচয় হয়। প্রাচীনকালেও বেদে কোথাও কোথাও এবং রামায়ণ মহাভারতেও দেখি রাধেয় (কর্ণ), কৌন্তেয় (প্রথম তিন পাণ্ডব), গাঙ্গেয় (ভীষ্ম), মাদ্রেয় (নকুল, সহদেব), বৈনতেয় (গরুড়), কাদ্রবেয় (কদ্রুর সপসন্তানরা), প্রভৃতি মাতৃ-পরিচয় ভিত্তিক নাম পাওয়া যায়। এগুলি ঠিক বংশপরিচয় না হলেও সমাজে এতটাই স্বীকৃত পরিচয় ছিল যে, ভীষ্মকে ‘শান্তনব’ বলে পিতৃপরিচয়ে খুব কমই অভিহিত করা হয়েছে। যেমন গরুড়কে কাশ্যপের সন্তান বা কর্ণকে অধিরথের পুত্র বলে তেমন উল্লেখ করা হয়নি। গঙ্গার ব্যক্তিত্ব রাজা শান্তনুর চেয়ে উন্নত ছিল। সে জন্য এ ধরনের মাতৃ-পরিচয়ের উল্লেখ স্বাভাবিক ও সঙ্গত বোধ করা হত বলে মনে হয়।

এগুলি কিন্তু ব্যক্তি-পরিচয়— বংশপরিচয় নয়। বংশের বেলায় সমাজ অনমনীয় ভাবে পিতৃতান্ত্রিক। তার একটা কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পিতৃকুলের পরিচয়ে পরিচিত সন্তান উত্তরাধিকারসূত্রে পিতৃপিতামহের সঞ্চিত বিত্ত লাভ করত। যে সব মাতৃতান্ত্রিক অঞ্চলে পুত্ৰ মায়ের সম্পত্তি পায়— যেমন দক্ষিণ ভারতের কোথাও কোথাও— সেখানে মাতৃপরিচয়েরই প্রাধান্য। বংশ সম্পত্তির ধারা বহন করে, তা ছাড়া মানুষ বিশ্বাস করে বংশগত গুণ (এবং দোষ)গুলিও উত্তরপুরুষে বর্তায়। আজ আমরা জানি, এ ধারণা যতটা সত্যি ততটাই মিথ্যে। বংশগত দোষগুণ একেবারেই বর্তায়নি এমন বহু দৃষ্টান্ত চারিদিকে পাওয়া যায়, সৎ মানুষের দুর্বৃত্ত পুত্র, মূর্খের বুদ্ধিমান বিদ্বান পুত্র, দাতার কৃপণ পুত্র এ সবের ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যায় এবং আজ ‘জিন’ চর্চায় বৈজ্ঞানিকরা তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও উদ্ধার করেছেন। কাজেই দোষ-গুণের ধারা সর্বত্রই বংশ ধরে দেখা দেয় এ ধারণা আজ আর বিদ্বজ্জনের কাছে গ্রাহ্য নয়।

তবে একটা জিনিস যা আইনের জোরে বংশে বর্তায়, তা হল বিত্ত। এই বিত্ত আপন ঔরসজাত পুত্রের হাতে রেখে যাওয়ার জন্যেই স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সংসর্গ থেকে সযত্নে দূরে রাখার কঠোর প্রয়াস সেই সুদূর অতীত থেকেই, যাতে পিতার সারা জীবনের সঞ্চয় নিজের ঔরসজাত পুত্র এবং পরে পৌত্রের হাতেই পড়ে। এখানে বংশের ধারাবাহিকতার একটা মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি পাওয়া যায়। তবে গুণ, বিদ্যাবুদ্ধি, যোগ্যতা যদি পুত্র-পৌত্র ধারায় সঞ্চারিত হয় তবে সমাজে বংশ অন্য এক ধরনের প্রতিপত্তির সূচনা করে, এবং কখনও কখনও তা হয়ও।

বেদের ব্রাহ্মণ অংশ থেকেই বংশ সম্বন্ধে একটা সম্ভ্রমবোধ দেখা যায়, উপনিষদেও বেশ কিছু বংশাবলি পাওয়া যায়। রামায়ণ, মহাভারতেও বংশতালিকা আছে; অর্থাৎ খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীতে ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও এর উদ্ভব আরও সাত-আটশো বছর আগে। পৃথিবীর অন্য দেশের প্রাচীন সাহিত্যেও বংশতালিকা দেওয়া থাকে, প্রধানত আগন্তুক জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ও অভিবাসনের ইতিহাস রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এবং সেই সঙ্গে সেই গোষ্ঠীর প্রাচীনতা ও আপেক্ষিক মাহাত্ম্য ঘোষণা করার জন্য। বংশাবলিগুলি লক্ষ করলে দেখি দু-চারজন প্রতিষ্ঠিত বা স্বনামধন্য পণ্ডিত বা ঋষি থাকলেও সুদীর্ঘ বংশতালিকায় অধিকাংশেরই পরিচয় দীন, নিষ্প্রভ। বাস্তবে তো এমনটাই হয়, যে-কোনও বংশতালিকায় দু-তিনটির বেশি উজ্জ্বল ব্যক্তির নাম থাকে না, তবু বংশটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ওই দু-তিনটি প্রসিদ্ধ মানুষের জোরেই। সমাজ এইটেই মেনে নিয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ অনার্য পরিবেশে কয়েকটি আর্যবংশ কিছু বিদ্বান ও গুণবান ব্যক্তির জোরেই নিজ বংশকে সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতেন। যেহেতু আর্যরা প্রাগার্যদের বরাবরই হেয় জ্ঞান করেছে, সে জন্যে প্রাগার্য সংস্কৃতিতে উন্নত কিছু আছে আর্যরা তা বিশ্বাসই করত না, তাই কখনও তার সন্ধানও করেনি। নইলে হয়তো তারা প্রাগার্য বংশের কিছু উন্নত গুণ, যোগ্যতা, বিদ্যা ও জ্ঞান সেখান থেকে আত্মসাৎ করে সমৃদ্ধতর করে তুলতে পারত। আবার আর্য সমাজের মধ্যে সকল বংশ প্রখ্যাত ছিল না; আমরা যে কটির নাম পরিচয় জানতে পারি, গোটা আর্যসমাজ তার মধ্যে নিবদ্ধ ছিল না, তাদের বাইরেও বহু বংশ ছিল, যাদের পরিচয়ের উল্লেখ শাস্ত্রে নেই। তারাও সমাজে হীন ও নত হয়েই ছিল। গুণী বা বিদ্বান জ্যোতিষ্কস্বরূপ বংশধর সে সব বংশে জন্মায়নি বলেই তাদের পরিচয় গৌণ থেকে পরে লুপ্ত হয়ে গেছে। সে সব বংশের ধারাও হয়তো বংশধরদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, কিন্তু কোনও উজ্জ্বল বংশধরের পরিচয় সে বংশতালিকায় ছিল না বলে সেগুলির স্বতন্ত্র পরিচয় শাস্ত্রে ছিল না, ছিল হয়তো বংশধরদের মনে, তাদের স্মৃতিতে। ব্রাহ্মণের বংশে যেমন ঋষি, বেদজ্ঞ, অধ্যাপক ও যজ্ঞকারী বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের দ্বারা বংশ উজ্জ্বল হত, ক্ষত্রিয় বংশে তেমনই যুদ্ধে বিজয়ী বীর বা শৌর্যবান বা দাতা ক্ষত্রিয়ের দ্বারাই বংশ খ্যাতিলাভ করত। কিন্তু ক্ষত্রিয় বংশতালিকা খুব কমই পাওয়া যায়, বৈশ্যের তো একেবারেই পাওয়া যায় না, আর শূদ্রের বংশধারা শূদ্রের কাছেও স্মরণীয় বোধ হত না, কারণ সে ছিল উচ্চ ত্রিবর্ণের সেবক— দাসের আবার বংশপরিচয় কী করে হবে! অতএব দেখা যাচ্ছে, বংশপরিচয় শুধু ব্রাহ্মণের। উপযুক্ত ব্রাহ্মণ রাজার কাছে প্রচুর দক্ষিণা ধনরত্ন পেতেন। ফলে যোগ্যতার সঙ্গেই থাকত ঐশ্বর্য, সমাজে বংশটির প্রতিপত্তি বাড়ত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ওই জাতীয় বংশতালিকার সন্ধান পাই না, এক প্রজন্মে কৃতী বীর বা ব্যবসায়ী নিজের পরিচয়েই প্রতিষ্ঠা পেত। তার বংশ পরিচয়ের সে ভাবে প্রয়োজন ছিল না। তাই শাস্ত্রেও তার নজির নেই।

গত দুই সহস্রাব্দে সমাজে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে; তার মধ্যে একটা প্রধান পরিবর্তন হল আজ গোষ্ঠীপরিচয় থেকে সমাজ ব্যক্তিপরিচয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর নানা কারণও আছে। বংশে নানা জাতির সংমিশ্রণ ঘটে গেছে, বহু বংশে আগের গৌরবের ভিত্তি নষ্ট হয়েছে। আগেকার পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত বংশগুলির অধিকাংশই ছিল আর্য এবং ব্রাহ্মণ, পরবর্তিকালে বহু অব্রাহ্মণ বংশের বংশধর নিজের কীর্তি ও যোগ্যতা দিয়ে, জ্ঞানবুদ্ধি, সৎকর্ম ও সমাজ হিতৈষিতার দ্বারা সমাজে সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেছে। এখনও অধিকাংশ প্রখ্যাত বংশই ব্রাহ্মণ কায়স্থ বা বৈদ্যকুলের, কদাচিৎ অন্য বর্গের মধ্যে কীর্তিমান পুরুষের খ্যাতিতে কোনও কোনও বংশ গৌরব লাভ করেছে। এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বংশ সমাজে প্রতিষ্ঠিত, যাদের অনেকেরই গোত্র-প্রবর পরিচয় জানা নেই। এ কথা দেশের বৃহৎ আদিবাসী সম্প্রদায় সম্বন্ধেও সত্যি: ওই ধরনের বংশপরিচয়ে তারা বিশ্বাসী নয়, কাজেই ওই হিসেব তারা রাখেও না। বৈদিক যুগে যে যোগ্যতার, কৃতিত্বের নিরিখে গোত্র-প্রবরের প্রতিষ্ঠাতারা স্বীকৃতি পেত, সেই যোগ্যতা, উৎকর্ষের নিরিখেই পরবর্তিকালে অব্রাহ্মণ বংশে প্রখ্যাত পুরুষের নামে বংশের ধারা প্রবর্তিত হয়।

একটা ব্যাপার কিন্তু বংশপরিচয়ে সার্বত্রিক, তা হল বংশপরিচয় নির্ধারিত হয় কোনও একটি পুরুষেরই নামে, কারণ সমাজটা আগাগোড়া পুরুষতান্ত্রিক। আজকের সমাজ পুরুষতন্ত্রকে প্রতিস্পর্ধা জানাচ্ছে, উপেক্ষা করছে এবং বলছে, এ ব্যবস্থা ন্যায়সম্মত নয়। আজকে পৃথিবীর সর্বত্রই নারী স্বাধীনতার জন্যে নারীপুরুষের সমানাধিকারের জন্যে আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বংশপরিচয় মূলত পুরুষের, নারীর নিজস্ব কোনও বংশপরিচয়ই নেই। কুমারীর পদবি পিতার, বিবাহিত বা বিধবার পদবি স্বামীর পদবির মধ্যে বংশপরিচয় নিহিত আছে। এই পদবির মধ্যে এক দিকে যেমন প্রকৃষ্ট ভাবে পুরুষতন্ত্রের ছাপ পড়ে এবং তেমনই ওরই মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে জাতি পরিচয় বা অনেকাংশে বংশপরিচয়। পদবিটির চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে নারীর স্বতন্ত্র স্বীকৃতি নেই, হয় সেটা তার বাবার পদবি নয় স্বামীর। তেমনই চট্টোপাধ্যায়কে সমাজ যে চোখে দেখে, মণ্ডল, নাই, দাস, বাউরি— এগুলিকে সে চোখে দেখে না কারণ, এরা সমাজে তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষ। এ দিক থেকে পদবি বর্জন করার দ্বারা এক আঘাতে জাতি বা বংশপরিচয় এবং নারী পুরুষের পৃথক পরিচয় অস্বীকার করা হয়। নানা কারণে দু-চারজন ব্যতিক্রমী মানুষ ছাড়া জনসাধারণ পদবি বর্জন করতে পারেননি। দাক্ষিণাত্যে নামের সঙ্গে গ্রামের নাম উল্লেখে একদা এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছিল, যেমন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। কিন্তু এটা তখনই সম্ভব, যখন বাসস্থানের পরিচয় দীর্ঘকাল ধরে একই থাকে। দেশভাগের পরে বহু পরিবারেরই বাসস্থানের পরিচয় তছনছ হয়ে গেছে, উদ্বাস্তুরা কোন পরিচয় দেবে? বর্তমানের বা আদিবাসস্থানের? তারপর বহু পরিবারের কর্মস্থলই ধীরে ধীরে বাসস্থান হয়ে ওঠে, তখন কোনটা তার যথার্থ বাসস্থানের পরিচয়? কাজেই বাসস্থানের পরিচয়টা পদবির বিকল্প হতে পারে না। অতএব পদবির যথার্থ কোনও বিকল্প নেই। পদবিতে বংশপরিচয় এবং পিতৃপরিচয় অথবা স্বামীর পরিচয় নিহিত থাকে এবং সেটা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চিহ্ন বহন করে।

সমস্যাটা হল একুশ শতকের সমাজ লিঙ্গভেদের সঙ্গে কোনও অধিকারভেদ জড়াতে রাজি নয়। একজন মানুষ পুরুষ বলেই একটু উঁচু আর একজন নারী বলেই নীচু— এ কথা এ সমাজ মানতে চায় না। কারণ বর্তমান সমাজ নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। এ কথা মেনে নিলে এখনকার সমাজের সমদর্শিতাকে একটু প্রসারিত করলেই অনুসিদ্ধান্ত হবে— বংশ একা পুরুষের নয়, নারীরও। যেখানে স্কুলে অভিভাবক হতে পারে মা, রেশনকার্ডে ‘গৃহস্থ’ হতে পারে নারী, হাসপাতালে মা ভর্তি করতে পারে অসুস্থ শিশুকে, আইনে সাক্ষ্য দিতে পারে অর্থাৎ তাবৎ সামাজিক এবং সাংবিধানিক ক্ষেত্রে নারী সমান অধিকার ভোগ করে। সেখানে বংশপরিচয় শুধু পুরুষকে দিয়েই কেন হবে? একটি শিশু শুধু পিতামহ বা পিতামহীরই নাতি বা নাতনি, মাতামহ বা মাতামহীর নয়?

বহু প্রাচীনকালে ‘দম্পতি’ শব্দের অর্থ ‘জায়া ও পতি’ ছিল না। ইন্দো-ইয়োরোপীয় নির্বাচনে ‘দমঃপতী’ এই ছিল অর্থ। দম মানে গৃহ (যার থেকে domestic), এই গৃহের পতি ছিল দুজন; স্বামী ও স্ত্রী; যে কারণে দম্পতি শব্দ নিত্যদ্বিবচন, এখানে জায়া ও পতির কর্তৃত্বের মধ্যে তত্ত্বগত ভাবে কোনও পার্থক্য ছিল না, কার্যত ছিল। কিন্তু এই প্রাচীন বোধটি তো এক ধরনের সমানাধিকারের নিরিখ। তার অনতিকাল পরেই অবশ্য নারীর অধিকার খর্ব হতে থাকে। এখন প্রশ্ন হল, আজ যখন সারা পৃথিবীতে নারীপুরুষের সমানাধিকারের জন্যে ব্যাপক আন্দোলন চলছে তখন বৈষম্যমূলক বংশপরিচয়ের বোধকে বর্জন করে নারীকেও বংশকর্ত্রী বলে স্বীকার করা সঙ্গত। সন্তান শুধু পিতৃপরিচয়ে নয়, মাতৃপরিচয়েও অভিহিত হোক, বংশও নিরূপিত হোক ঊর্ধ্বতন প্রজন্মের পুরুষ এবং/অথবা নারীর পরিচয়েও। 

ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র পরিচয়ের চেয়ে কি গান্ধারীর পুত্রপরিচয় কোনও অংশে ন্যূন? দশরথের পুত্র যদি কৌশল্যার পুত্র বলে পরিচিত হয় তো সেটা বেশি সম্মানের। এখনও পৃথিবীর কৃতী নারী ও কৃতী পুরুষের মধ্যে তারতম্য রক্ষা করে, নইলে পিতামহ-মাতামহ এবং পিতামহী-মাতামহী উভয়েরই পৌত্র পৌত্রী যে-কোনও পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার থাকা উচিত ছিল। এবং আজ যে-কোনও বংশের পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় তা ঠিক করুক সেই উত্তরপুরুষই, বংশপরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন ঘটলে। তবে সেটা সাম্যদৃষ্টিতেই নিরূপিত হোক

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।