আপনি ‘পভার্টি ফটোগ্রাফ’ লিখে গুগলে সার্চ করলে দেখবেন, ৯০% ছবিই সাদাকালো। ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো দারিদ্র্যের ‘অ্যাস্থেটিক ফোটোগ্রাফিরও বেশির ভাগ রঙহীন। এর কারণ ভেবে দেখেছেন কী?  

গরিব কি আসলেই বেরঙিন? 

আমাদের সমাজের কম আয় সম্পন্ন মানুষের দিকে তাকালে আমরা হয়তো চিত্রটা ঠিক তেমন দেখবো না। সকালে ক্লাসে বা কাজে বেরুলে গার্মেন্টসে কর্মরত মানুষদের যে ঢল আমরা দেখি তাদের বেশিরভাগের পরনেই থাকে উষ্ণ রঙের বড় বড় প্যাটার্নের পোশাক সাথে রঙিন ফিতার চপ্পল। রিকশাচালকদের শার্ট হয় রঙ, প্যাটার্ন ও লেখা সর্বস্ব। টং দোকানিরাও ‘ধূসর’ নন। শহরে ‘বস্তি’ হিসেবে পরিচিত আবাসনগুলোর ইন্টেরিয়রেও থাকে রঙিন চাদর, পর্দা, টেবিলক্লথের ছড়াছড়ি। রঙের বহুল ব্যবহার বা ‘বাহুল্য’কে সমাজে বরং দেখা হয় প্রায়শই ‘ক্ষ্যাত বা ছোটলোকি’ সংস্কৃতি হিসেবে (এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে লেখার পরবর্তী অংশে)।  

তাহলে দরিদ্র মানুষের ছবি থেকে রঙ তুলে নিয়ে আসলে কী সিম্বোলাইজ করে?

ফোটোগ্রাফার মাইক লাশমোর তার ‘পোভার্টি ইজ নট সো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’ লেখায় মনে করেছেন যে, এ ধরণের দু’রঙা ছবির একটা উদ্দেশ্য থাকে গরিব মানুষের প্রতি কিছুটা জোর করেই সিম্প্যাথির সৃষ্টি করা, তাদের করুণ অবস্থাকে আরো করুণতর, রঙহীন করে।   

লাশমোরের মত আমারও একটা হাইপোথিসিস আছে। আমরা মনে করি দরিদ্র মানুষ অতীতে বসবাস করে, ঠিক বর্তমান বা আধুনিকের অপর পাশে। থ্রি ইডিয়টস ছবিতে রাজু রাস্তোগি চরিত্রের নিম্ন আয়ের বাড়িতে গেলেই সব সাদাকালো হয়ে যায়, এমনকি স্ক্রিনের উপর পুরোনো দিনের ছবির ঝিরিঝিরি দাগও দেখা যায়। এই দৃশ্যটি বলিউডের ৭০-৮০ দশকের “জীবনঘনিষ্ঠ” ওরফে রিয়েলিস্ট সিনেমার গল্পের ধরণ ও বলার ঢংয়ের স্যাটায়ার। এই ধরনের গল্প বলার টুল বেছে নেওয়ার কারণ মানুষ দুর্দশা দেখলে সে যুগের সেই সাদাকালো ছবির কথাই ভাবে। মানুষগুলোও ছবি মুক্তি পাওয়ার সেই সময়ে আটকা।  

কেননা আমরা যাপনে নানা প্রযুক্তির অভাবকে ও কিছু নির্দিষ্ট ধ্যান-ধারণাকে অতীতের বিষয় হিসেবেই দেখি। এর নানা বিশেষণও আছে আমাদের ঝুলিতে। যেমন, ওল্ড ফ্যাশনড, ব্যাকওয়ার্ড, প্রিমিটিভ, ব্যাকডেটেড, আদিম, অসভ্য ইত্যাদি। এক কথায় বললে, অমুকটা না থাকলে ‘আধুনিক’ হয়নি, তমুকটা বললে অতীতেই আছে। যে অতীতে আছে তার ছবিও সেই অতীতের সাদাকালো, সেপিয়া এফেক্ট দেওয়া হবে তাই তো স্বাভাবিক।  

রঙ বা তার অভাব নিয়ে যারা ভিজুয়াল তৈরি করে আর যারা তার গ্রাহক আমরা উভয়ই  এক ধরনের পারসেপশন আর স্টেরিওটাইপের রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছি, পার্থক্য এটাই যে কেউ জেনে নিচ্ছি আর কেউ না জেনে। 

‘ক্ষ্যাত’ রঙ বা গর্জিয়াসের মধ্যে গর্জিয়াস বৃত্তান্ত  

কটকটা-ক্যাটক্যাটা, ক্ষ্যাত, লাউড, তীব্র, চোখে লাগা, দুবাইওয়ালা, বস্তি, ছাপড়ি ইত্যাদি বিশেষণে আমরা কিছু রঙকে বা রঙের শেডকে বিশেষায়িত করি। আবার আনুশকা শর্মার বিয়ের প্যাস্টেল রঙগুলোকে ‘ক্লাসি’-ও বলি সবাই তৎক্ষনাৎ। শুরুতে যে নাক কুঁচকানো রঙগুলোর কথা বলা হলো সেগুলোও অবশ্য ভিনদেশী পপ আইকনেরা (নিকি মিনাজ, কারডি বি, হ্যারি স্টাইল অ্যান্ড কোঃ) পরলে ‘নিয়ন’ নামে সমাদর পায়।  

এই যে কোনো রঙকে অচ্ছুৎ ঘোষণা বা কোনো রঙকে ‘জাতে’-র ভাবা এটা আসলে কারা কীভাবে ঠিক করে? এটা করায় কী সুবিধা হয়?

চ্যাপা শুটকি, গরুর বট, জর্দা দেওয়া পানের মত কিছু খাবার আমাদের সমাজে গরিবের খাবার হিসেবে পরিচিত। কখনো দোষ দেওয়া হয় এসব খাবারের ‘উৎকট’ গন্ধকে কিন্তু মূলত এই খাবারগুলোর কম মূল্য খাবারগুলোর  গরিবের খাবারের মর্যাদা এনে দেয়। এক সময় ছোট মাছকেও গরিবের খাবার হিসেবে দেখা হত এবং ঢাউস সাইজের রুই-কাতলা ছিল স্বচ্ছলতার চিহ্ন। ছোট মাছের দাম বাড়ার পর এবং যোগান কমার পর এখন তা আবার বড়লোকের খাবার। এমন এটা গরিবের, ওটা বড়লোকের হিসেবে কিছু জিনিসকে শ্রেণীভুক্ত করা আসলে কেন প্রয়োজন? 

নিজেকে ঐ শ্রেণীভুক্ত খাবার খাওয়া বা কাপড় পরা মানুষগুলো থেকে আলাদা করতে। নৃবিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্বে একটা প্রক্রিয়ার নাম প্রায়ই শোনা যায়ঃ আদারিং  বা অপরায়ন। এটা হলো কাউকে ‘অপর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ আমি সে বা তার দলভুক্ত নই। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে এই আদারিং সবসময় নিজের চেয়ে কম ক্ষমতা বা বিত্তশালী গোষ্ঠীকে করা হয়। নিজের চেয়ে ক্ষমতাবান অংশকে বরং অনুকরণ করা হয়, তার সাথে একই শ্রেণীভুক্ত হওয়া হয় গর্বের বিষয়।  

উপনিবেশকতার সময়ে যেমন যা কিছু উপনিবেশিত রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীগুলো খেতো, পরতো, করতো তা ছিল ছোটলোকের কাজ এবং তারা ছিল ‘আদার’ পশ্চিমাদের কাছে। পিতৃতন্ত্রে নারীর যেকোনো কাজ বা পছন্দ ‘মেয়েলি’ যা পুরুষ করলে তার ‘জাত’ নিচে নামবে কারণ নারী পুরুষের আদার। রঙের ক্ষেত্রেও এমন আদার-এর রঙ আছে, বিত্তশালীর রঙ আছে। কোনো রঙ ক্ষ্যাত বলেই তো অন্য রঙটা এলিট হতে পারে।     

লেখার শুরুর অংশে বলা হয়েছে যে আমাদের চলাফেরায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাপড়ে আমরা বহু রঙ ও প্যাটার্ন দেখি – এগুলোই সমাজে ক্ষ্যাত বা কটকটা বলে পরিচিত। সকল নিম্ন আয়ের মানুষই যে এসব রঙের পোশাকই পরে তাও নয়, হয়তো আমাদের চোখে শুধু রঙিন কাপড়গুলোই পড়ে স্বাভাবিকভাবেই। আর এই ধরনের পোশাক যদি সেই গোষ্ঠীর বেছে নেয় তবে তারও নানা কারণ থাকতে পারে।  হতে পারে যে এ ধরনের রঙের কাপড় ময়লা হলে কম দেখা যায় যেহেতু কায়িক শ্রমের চাকরিতে এবং পাবলিক পরিবহনে কাপড় ময়লা হওয়াটাই স্বাভাবিক, এগুলো ছিড়ে গেলে সেলাই বা ‘রিপু’ করলেও আলাদা করে চোখে পড়ে না আর ফিকে হলেও কাপড়ের বয়স বোঝা যাওয়া দুষ্কর। এই লেখাটা লেখার সময় আমরা সাতদিন সাদা প্যান্ট, সাদা জুতা পরে চলাফেরা করার চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের একজনের বাসা মোহাম্মদপুরে, আরেকজনের ভূতের গলিতে এবং দু’জন ঢাকার দুটো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। মোটামুটি ডে থ্রিতেই আমাদের জুতো, জামা আর পরার মত ছিল না আমাদের পারিপার্শ্বিকের দরুন। ঢাকার দু-তিনটি ‘গেটেড’ পাড়া ছাড়া সব অঞ্চলেই এমন অবস্থাই হওয়ার কথা। সেসব অঞ্চলের কাপড়ের আর ঘরের ইন্টেরিয়রের ধরন ও রঙও যে সমাজে ‘মার্জিত’ বা ‘রুচিশীল’ হিসেবে পরিচিত এ নিয়েও খুব আশ্চর্য হবার কিছু নেই। 

রুচির পাহারাদার মধ্য ও উচ্চবিত্তের মধ্যে কোনো ‘দুর্ভিক্ষ’ দেখতে চান না বলেই আমরা জানি। তাদের আরোপিত রঙের মাত্রাজ্ঞানকে তাই আরেকটু খতিয়ে দেখা চাই।   

পশ্চিমের ক্রোমোফোবিয়া বা রঙ বিমুখতা

২০০০ সালে শিল্পী ডেভিড ব্যাচেলরের ক্রোমোফোবিয়া নামে একটা বই প্রকাশিত হয় রিকশন প্রকাশনী থেকে। ক্রোমোফোবিয়া বলতে তিনি বুঝান রঙের প্রতি ভয় বা বিমুখতাকে এবং তিনি এটাকে পশ্চিমা শিল্প ও সংস্কৃতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে হাজির করেন। তিনি একের পর এক উদাহরণ হাজির করেন যেখানে পশ্চিমের এ ফোবিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় দৃশ্যশিল্পে।   

যেমন, ১৯৩৯ সালের উইজার্ড অফ অজ ছবিতে একজন কিশোরী একটি ‘স্বাভাবিক’ রঙহীন জগতে বসবাস করে। এক পর্যায়ে সে একটি গর্ত বা পোর্টাল দিয়ে একটি ‘অদ্ভুত’ রঙিন জগতের দেখা পায়। এক সময় আমরা জানতে পারি এর পুরোটাই ছিল একটি স্বপ্ন বা ‘ফিভার ড্রিম’। এই ছবিতে রঙিন দুনিয়া ‘মোহ’ বা অসত্য জগতের হাতছানি দেয়, সেটা আকর্ষণীয় হলেও সত্য বা আদর্শ নয়।  ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অক্টোবর আর্ট ম্যাগাজিন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় আর্ট ম্যাগাজিন। অথচ এ ম্যাগাজিনের পুরোটাই সাদাকালো! কিন্তু এই ম্যাগাজিনেই পাওয়া যেত ‘উচ্চমার্গীয়’ আর্ট ও রুচির খোঁজ। বলে রাখা ভালো যে এই ম্যাগাজিন বাংলাদেশের বহু শিল্প প্রকাশনার ন্যায় অর্থের অভাবে রঙহীন ছিল না। 

ব্যাচেলর এই উদাহরণগুলোর পাশাপাশি ইতিহাসের দিকেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখান যে, চিরকাল উপনিবেশিত দেশগুলো ছিল রঙের পিগমেন্টের খোরাকের দিক দিয়ে পশ্চিমের উপনিবেশক দেশগুলোর তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ। রঙের পিগমেন্ট অর্থাৎ যা দিয়ে কোনো রঙ পুনুরুৎপাদন করা যায় আর যে কোনো রঙিন উদ্ভিদ বা খনিজ এক নয়। যেমন, নর্থ আমেরিকার বিখ্যাত সুগার মেপল গাছের ফল ঋতুর লাল-কমলা পাতা থেকে লাল-কমলা রঙের পিগমেন্ট পুনরায় কিছুকে সে রঙে রাঙানোর জন্য ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় মেহেদি পাতা থেকে খয়েরি-কমলা রঙের পিগমেন্ট তৈরি করা সম্ভব। নীলের পিগমেন্টের অন্যতম উৎস ইন্ডিগো গাছ পাওয়া যায় আফ্রিকা ও এশিয়াতে, লাল পিগমেন্টের গাছ ম্যাডারের ক্ষেত্রেও উৎপত্তিস্থল ভারত আর এশিয়ার অন্য কিছু অংশ। হলুদ, স্যাফ্লাওয়ার, কলানাট, কাচ ইত্যাদি অনেক উদাহরণ এখানে যোগ করা যায়। 

পশ্চিমে পিগমেন্টের অপ্রতুলতা উপনিবেশিকতার দশকগুলোতে তাদের দুটি জিনিসের দিকে ধাবিত করে।
এক. রঙ ও রঙিন সবকিছুকে বন্য, মেয়েলি, মোহময়, কুরুচিপূর্ণ (সভ্য, পুরুষালি, সত্য, রুচিশীলের ঠিক বিপরীত অর্থাৎ পশ্চিমা এনলাইটেনমেন্ট চিন্তাধারার ঠিক উল্টোটা) বলে আখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে আদারিং করা।
দুই. প্রচুর পিগমেন্ট উপনিবেশিত দেশগুলো থেকে নিয়ে আসা (উপনিবেশিত ভারতের নীলচাষ ও বিদ্রোহের ইতিহাস এই ক্ষেত্রে একটি উপযুক্ত উদাহরণ)।    

দ্বিতীয়টা ঘটলে প্রথমটা কেন বিরাজমান থাকবে এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসকেরা আমাদের অঞ্চল থেকে অনেক মসলাও নিয়েছিলো কিন্তু তারপরও ভারতীয়-চীনদেশীয় মশলার ‘স্বাদ-গন্ধ’ নিয়ে ও দেশে এই দশকেও পড়তে যাওয়া এশীয় ছাত্ররা কম বুলি হয় না, আগের কথা আর না-ই লিখলাম। আসলে ঐতিহাসিক ঘটনা বা শাসন একরৈখিক ফলাফল বয়ে আনে না, রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে বহুরৈখিক চিন্তার ঘরানা ও বৈষম্য আছে। বৈষম্য পদ্ধতিগতভাবে শেখানো হয় যে গ্রুপের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে তাদেরও। এভাবে সৃষ্টি হয় নিজ জাতি ও সংস্কৃতির নানা কিছুর প্রতি বৈষম্যমূলক মানসিকতা। বৈষম্যের শিক্ষা পদ্ধতি কখনো প্রত্যক্ষ যেমন কোনো কিছু নিষিদ্ধ করে দেওয়া, আবার কখনো পরোক্ষ বা হেজেমনিক যেমন, আর্ট গ্যালারিতে, পত্রিকায় বা সিনেমার জগতে কিছু বিশেষ দৃশ্য বা স্টাইলকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে অন্যগুলোকে খারিজ বা অজনপ্রিয় করা। 

ঔপনিবেশিকতা, পিতৃতন্ত্র, ধনতন্ত্র এগুলো ব্যক্তিক ও সামাজিক পর্যায়ে এক ধরনের মানসিকতা ও চর্চাও বটে। তাই এ দেশে কোনো রঙকে বিশেষণে চিহ্নিত করার পিছে এগুলোর কারণ থাকতেই পারে। কোন এলাকার ঘরবাড়ি, শোরুম, কাপড়ে কোন রঙ এগুলো খতিয়ে দেখবার সময়, কিংবা কোন রঙকে আমরা কেমন বলে চিনি, কার রঙ বলে চিনি এগুলো ভাবার সময় তাই এসবের পিছে কোন অন্তর্নিহিত সামাজিক বা ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে তাও ভাবার অবকাশ আছে। 

মেন ইন ব্ল্যাক এবং শুধুই ব্ল্যাক

আপনি যদি মেয়ে হন, তাহলে খুব সম্ভব যে আপনি আপনার একাধিক ছেলে বন্ধু, সহপাঠী বা ভাইকে শীতকালে কোনো ভীড়ভাট্টার ভেতর একে অন্যের সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারেন, কারণ শতকরা ৯০ ভাগ সম্ভাবনা আছে যে তাদের বেশিরভাগই কালো পোশাক পরে আছে। আর কোন কনসার্ট বা কোন কলেজ ফেস্ট হলে তো কথাই নেই, দেখবেন আপনি ভাসছেন কালোর বন্যায়।  

কারণ আমাদের চর্চায় এখন কালো হলো ‘ক্লাসি’ এবং ‘পুরুষালি’।  কালো রঙ ‘স্মার্ট’, কোনো রঙের উপদ্রব নেই এখানে, নেই কোন উজ্জ্বলতার ঝামেলা। বরং, কালো রঙ যেন এখন সব রঙের উর্ধ্বে এক ছড়ি ঘোরানো এক এলিট রঙ।  

কিন্তু আমাদের এ অঞ্চলে কালো রঙের এহেন প্রসার ও ক্ষমতা কি শুরু থেকেই ছিলো? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘সেই সময়’-এ অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জামার রঙের বর্ণনা আছে, কিন্তু উকিল ব্যতীত কালো পরিহিত চরিত্র নেই বললেই চলে। ইতিহাসের পাতায় ভারতীয় পোশাক-আশাকে কালো খুবই অজনপ্রিয়। বর্তমানে কালোর প্রতি আগ্রহ, অন্য অনেক কিছুর মতোই পশ্চিম থেকে আমদানীকৃত। পশ্চিমের ক্রোমোফোবিয়ার কথা তো উপরেই বলা হলো, রঙবিমুখদের প্রিয় রঙ স্বভাবতই কালো।    

পশ্চিমে কালো রঙের ইতিহাসেও মিশে আছে ধর্ম, রাজনীতি ও বাণিজ্য। ইউরোপে প্রটেস্টেন্ট আন্দোলন আর ডাচ মার্কেন্টাইলিজমের প্রভাবে কালো ছিল আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, ত্যাগের নিদর্শন। এভাবে চার্চের পাদ্রী বা ধর্মপিতাদের পোশাকের রঙ থেকে বাইবেলের কাভারের রঙ হয়ে ওঠে কালো, যেখানে ‘ছলনাময়’ ওরফে ‘আবেদনময়ী’ রঙের কোনো জায়গা নেই। পশ্চিমের আদালতের আইনজীবী ও বিচারক অর্থাৎ সমাজের আক্ষরিক নীতিনির্ধারকদের রোবের রঙ কালো। ফলে  মৌসুমী আবহাওয়ার গরমের দেশেও সেই কালো রোব পরে উকিলদের ঘামতে দেখা যায় প্রত্যহ। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে যেই নব্য ভদ্রলোক শ্রেণীর উদ্ভব হয়, সেই ‘ব্যাংকিং ক্লাস’ এর কোট ও জামায় ছিল ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেলের ছাপ। সেই শ্যানেলের কালো সারা পৃথিবীর কাছে হয়ে উঠে আভিজাত্য, পরিশীলতা আর নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতীক। আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এই শাসনের রঙই যে পুরুষালি রঙ হয়ে উঠবে, তা নতুন কিছু নয়!   

রিকশাচালকদের শার্ট হয় রঙ, প্যাটার্ন ও লেখা সর্বস্ব। টং দোকানিরাও ‘ধূসর’ নন। শহরে ‘বস্তি’ হিসেবে পরিচিত আবাসনগুলোর ইন্টেরিয়রেও থাকে রঙিন চাদর, পর্দা, টেবিলক্লথের ছড়াছড়ি।

পৃথিবীজুড়ে এখন ‘বার্বেনহাইমার’ উন্মাদনা। এখানে বার্বির ‘মেয়েলি’ ব্র্যান্ড কালার গোলাপির বিপরীতে, ওপেনহাইমারের রঙ হিসেবে দ্বৈরথে দাঁড় করানো হয়েছে পুরুষালি কালো রঙকে। অথচ, ওপেনহাইমার কোন মাল্টিমিলিওন-ডলার খেলনার কোম্পানি নয় যার ব্র্যান্ড কালার থাকবে।  এমনকি এই সিনেমার প্রচারণার কোনো পোস্টারেও কালো রঙের তেমন ব্যবহার ছিলোনা। তাও সোশ্যাল মিডিয়া ও সিনেমা হলজুড়ে উৎসাহী দর্শকেরা কালোর সাথে ওপেনহাইমারকে সংযুক্ত করেছে, নিজেরা কাল জামা পরে এ ছবি দেখতে গিয়েছে। মেয়েলি গোলাপি বার্বির বিরুদ্ধে এ যেন এক কঠোর পুরুষালি জবাব!  

গোলাপি ‘মেয়েদের রঙ’ কী করে হল?

গোলাপি কি চিরকালই ‘মেয়েলি’ রঙ ছিল? সব মেয়েরই কি গোলাপি পছন্দ? দুটোর উত্তরই স্বাভাবিকভাবে, না। 

গোলাপিকে মার্কিন মুল্লুকে ১৮ শতকে প্রথম ‘লিঙ্গীয় রঙ’ হিসেবে নির্মাণের চেষ্টা করা হয় শিশুদের পোশাক ও খেলনার মাধ্যমে কিন্তু এটা হওয়ার কথা ছিল ছেলে শিশুদের রঙ! ‘গোলাপি আগ্রাসী ও বিপ্লবী রঙ লালেরই একটি শেড তাই এটা পুরুষালি রঙ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল’ – বলেন প্যান্টন কালার ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লিয়াট্রিস আইজম্যান। কিন্তু শিশুপণ্য বিক্রেতারা এ দু রঙের মধ্যে কোনটা কোন লিঙ্গের তা নিয়ে একমত হতে পারেন না এবং শেষমেষ শিল্পী হেনরি হান্টিংটনের ‘দ্যা ব্লু বয়’ ও ‘পিংকি’ নামে দুটো পেইন্টিং (প্রথমটিতে নীল পোশাক পরা ছেলে শিশু এবং দ্বিতীয়টিতে গোলাপি পোশাক পরা মেয়ে শিশু আছে) অনেক জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর মার্কেটে ছেলেদের নীল পোশাক এবং মেয়েদের গোলাপি পোশাকের যোগান ও কাটতি দুটোই বেড়ে যায়। এভাবেই গোলাপি মেয়েদের রঙ ও নীল ছেলেদের রঙ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

আইজম্যান আরো জানান যে, এটি মুলত আরো বেশি শিশুপণ্যর বিক্রি নিশ্চিত করতে এক ধরনের মার্কেটিং তরিকা ছিল। বেশি বিক্রি হবে কেননা বড় ভাইয়ের পোশাক তবে ছোট বোন পরবে না এবং ভাইস ভার্সা। সব শিশুরই কিছু নতুন কালার কোডেড পোশাক ও খেলনা কেনার চল দেখা যাবে।  হয়েছিলও তাই। ১৯২০ নাগাদ মোটামুটিভাকে আমেরিকান সমাজে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পুরো পুঁজিবাদী আন্তর্জাতিক মহলেই গোলাপি এবং নীলের লিঙ্গ নির্ধারণ হয়ে যায়।  

এখন প্রায় একশো বছর পর নারীর রঙ হিসেবে পরিচিত গোলাপির বহু নির্মাণ-বিনির্মাণ ঘটেছে। গোলাপি বর্জন, তার পরবর্তী সমাদর (বার্বি ফ্র্যাঞ্চাইজ ও মুভি দ্রষ্টব্য), আবার সেই সমাদরের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যের সমালোচনা (বারবি ফ্র্যাঞ্চাইজ ও মুভি পরবর্তী আলোচনা দ্রষ্টব্য) শেষে অন্তত এইটুকু বলা যায় যে, গোলাপির যেই সংযোগ লিঙ্গের সাথে করা হয় সেটাকে মাথা থেকে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব। এখন গোলাপি নারীর জন্য সচেতনতামূলক কার্যকলাপ যেমন জাতিসংঘের ব্রেস্ট ক্যান্সার আওয়্যারনেস ক্যাম্পেইনে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি নারীদের উপর করা বৈষম্যমূলক আচরণ যেমন ফেমিনিন পণ্য (স্যানিটারি প্যাড, মেন্সট্রুয়াল কাপ, ভ্যাজাইনাল ওয়াশ ইত্যাদি) ইত্যাদির উপর আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের বিরোধী আন্দোলনকারীরাও নারীর এই বিশেষ ট্যাক্সকে ‘পিংক ট্যাক্স’ নামে অভিহিত করেন। কিন্তু রঙের রাজনীতি কালো-গোলাপিতেই শেষ হয়ে যায় না।     

নীল পৃথিবীর বিরল নীল 

ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে হয় যে, মানবজাতি হিসেবে নীল রঙের প্রতি এক দুর্বোধ্য আকর্ষণ আছে আমাদের। সিএনএনের বিখ্যাত কালারস্কোপ সিরিজে তারা দাবি করে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিহিত রঙ নীল। ব্লু জিন্স থেকে স্কুল ইউনিফরমের নেভী ব্লু প্যান্ট, বা এদেশীয় নীল চেক ডিজাইনের লুঙ্গি – পৃথিবীজুড়ে সবাই এ রংটাকে আপন করে নিয়েছে, হয়তো খুব বেশি না ভেবেই। নীলের প্রতি এই দুর্বলতার শুরুটা কখন?     

৩০ লক্ষ বছর আগে যখন মানুষ পা ফেললো এই রুক্ষ ধরায়, মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখলো  দেখে বিস্তৃত নীলাভ ধূসর আকাশ। আবার অমাবস্যার অন্ধকার আকাশে সেখানে দেখা যায় নীলচে তারা আর ছায়াপথের আবছা ছবি, কিংবা সুবিশাল সমুদ্রের দিকে চেয়ে সে দেখে গাঢ় নীল জল।  কিন্তু এই নীলের পুরোটাই দৃষ্টিভ্রম, আলোর কারসাজি। পানি, আকাশ যে কোনোটার ক্যাঁচে বা ভেতরে গেলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিজ্ঞানও সেটাই বলে। এমনকি, নীলরঙা চোখের মণি নিয়ে যে এত মাতামাতি প্রকৃতপক্ষে সেটাও নীল না, বাদামী আইরিশের ছলচাতুরি – এর বিজ্ঞানটা গুগল করে দেখলে বেশ মজা পাবেন। 

যাহোক আপাতভাবে নীলের  প্রকৃতিতে নীলের প্রাচুর্য মনে হলেও একটু ভেবে দেখুন তো, কয়টা নীলরঙা ফল আর সবজি আপনি চেনেন? কিংবা গাঢ় নীল বা আকাশি রঙের কোন জন্তু? আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, প্রকৃতির দুর্লভতম রঙ নীল। কোনো এক অদ্ভুত পরিহাসে, পৃথিবী নামক এই নীলচে গ্রহটা তার পরিবেশে লাল, হলুদ, সবুজ – সকল রকম রঞ্জকের মাঝে নীলকে হাপিস করে দিয়েছে প্রায়। সেটা প্রাণী আর উদ্ভিদ উভয়ক্ষেত্রেই। হিসেবে বলে, ৬৪ হাজার ভার্টিব্রেট, অর্থাৎ মেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কেবল দুইটি প্রজাতির গায়ে নীল রঙ আছে। বাকি বেশিরভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রে সে রঙটা এক ইল্যুশনের মাধ্যমে তৈরী, দেহের কোন রঞ্জক থেকে নয়।    

আমরা মানুষের ইতিহাসের দিকে ফিরলে দেখি, অনেক প্রাচীন সভ্যতায় নীল রঙের জন্য কোন নাম ছিলোনা, অর্থাৎ সেইসব প্রাচীন মানুষের চোখে নীল ধরা দিত অন্য কোন রঙের হিসেবে, অথবা তার বাইরের কোন ধাঁধাঁ হিসেবে। এমনকি, হোমারের অমর পুরাণ ইলিয়াডে নীল রঙের কোনো উল্লেখ নেই। হয়তো সেকারণেই পরবর্তীতে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, সভ্যতায় দেখি এই নীল রঙকে ব্যবহার করা হয়েছে স্বর্গীয়, আধ্যাত্মিকতার যোগসাজশে।   

সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদজুড়ে মাইকেল্যাঞ্জেলোর সেই অমর সৃষ্টির ব্যাকগ্রাউন্ডের রঙ আকাশি নীল, অর্থাৎ মাইকেল্যাঞ্জেলো স্বর্গকে একেছিলেন নীল রঙ দিয়ে। ইউরোপজুড়ে সুউচ্চ আর থমথমে যেসব গথিক ক্যাথেড্রাল আর চার্চ আমরা দেখি, সেখানে রঙিন ঘষা কাঁচের জানালা একটা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। বৃত্তাকার বা লম্বাটে এসব রঙিন কাচের জানালা দিয়ে আলো পড়ে ক্যাথেড্রালের ভেতরটাকে নানান রঙে জ্বেলে এক ঐশ্বরিক মুহূর্ত তৈরী করতো, সেই রঙিন কাচ বা স্টেইন-গ্লাস উইন্ডোতেও আমরা নীল কাঁচের আধিক্য দেখি। এভাবে নীল হয়ে উঠলো দেবত্বের রঙ, এক অপার্থিবতার রঙ।  

নীল রঞ্জককে মানুষ প্রথম তৈরী করতে সক্ষম হয় হয় লাপিস লাজুলি নামক এক পাথর থেকে, যে পাথরের সবচেয়ে বৃহৎ খনি পাওয়া গিয়েছিলো বর্তমান আফগানিস্তানের এক অঞ্চলে। সেই লাপিস লাজুলির চূর্ণের সাথে মোম ও অন্যান্য দ্রব্যাদি মিশিয়ে তৈরী হয় এই নীলরঙা রঞ্জক, শোনা যায় সেযুগে স্বর্ণের চেয়েও দামী ছিলো এ পাথর। আর ভূমধ্যসাগর পারি দিয়ে ইউরোপ আসতে আসতে তাই নীল রঙের দাম হয়ে উঠে আকাশচুম্বি। এতোটাই বেশি, যে সেসময় কোনো পৃষ্ঠপোষক ( মূলত চার্চ ও পরবর্তীতে বনেদি বণিক পরিবারগণ)  যখন কো্নো শিল্পীকে ফরমায়েশ করতেন কোন ছবির জন্য, তখন সে ছবিতে নীল রঙ ব্যবহার করতে হলে তাকে অতিরিক্ত মূল্য চোকাতে হতো।  একারণে গ্রেকো-রোমান পিরিয়ডে ও রেঁনেসার সময় যেসব খৃষ্ট ধর্মীয় পেইন্টিং আমরা দেখতে পাই, সেগুলোতে নীল কেবল ব্যবহৃত হয়েছে ম্যাডোনা এবং যীশুর গায়ের জামায়। অর্থাৎ সবচেয়ে দামী রঙটা ছবির এবং ধর্মের সবচেয়ে সম্মানিত এবং ঈশ্বরের নৈকট্য পাওয়া ব্যক্তির গায়েই থাকে। এভাবে, নীল রঙ  বিশ্বশিল্পের ইতিহাসে জড়িয়ে গেল সম্মান ও ঐশ্বরিকতার সাথে।  

কেবল ঈশ্বরের পরেই যাদের স্থান, অর্থাৎ সমাজের উঁচুশ্রেনীর লোকেরা, সেটা রাজা থেকে বড় ব্যবসায়ী, ডিউক কিংবা ভূপতি পর্যন্ত; তাদের নিজের প্রতিকৃতিতে নীল ব্যবহার করে নীলকে প্রতিষ্ঠিত করেন রাজকীয় রঙ হিসেবে। আর যেখানেই রাজা ও রাজার পরাক্রম থাকে, সেখানেই থাকে বঞ্চিত লোকদের উপর অত্যাচার। সাদা চামড়ার বাবুদের এই অঞ্চলের নীল চাষের প্রতি লকলকে লোভ তার সবচেয়ে উদাহরণ। ১৭৭৭ থেকে প্রথমে একচেটিয়া ভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ও পরবর্তিতে কোম্পানির বাইরের অসংখ্য ব্রিটিশ বণিক নদীয়া, যশোর ইত্যাদি অঞ্চলে অসংখ্য নীলকুঠি স্থাপন করে কী ভীষণ অত্যাচার চালায় নীলচাষিদের ওপর, তা আমাদের অজানা নয়। 

রঙ হিসেবে নীলের ইতিহাস রক্তাক্ত হলেও, এখন নীলের আরও অনেক রূপ আমরা দেখি চারপাশে। আমাদের সবচেয়ে চেনা ভার্চুয়াল দুনিয়া হলো ফেসবুক, যার Azure Blue রঙে ডুবে ডুবেই হয়তো এই লেখার খোঁজ পেয়েছেন আপনি। ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ নিজে রেড-গ্রিন টাইপের বর্ণান্ধ হওয়ার কারণেই ফেসবুকের রঙ নীল রেখেছিলেন। বেশিরভাগ বর্ণান্ধ মানুষেরা নীল রঙটাই সবচেয়ে বেশি দেখতে পায়। কাজেই নীল রঙ এখন ডিজেবিলিটি-বান্ধব রঙও বটে। আর এ দেশে নীল প্রতিদিনকার রঙ, সেটা রিকশার হুড থেকে নীল ঢেউটিন, নীল অপরাজিতা থেকে লুঙ্গির ভাঁজ পর্যন্ত। অর্থাৎ নীলও অন্য সব রঙের মত তার ইতিহাস বা একরৈখিক পরিচয় বা নির্মাণেই আবদ্ধ নয়।

রঙের মনস্তত্ব ওরফে সমাজতত্ত্ব

শুধু লিঙ্গ, রাজনীতি বা শ্রেণীপরিচয় নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে লম্বা সময় ধরে রঙকে মানব অনুভূতি, বক্তব্য বা ভাবনার সাথেও সংযুক্ত করা হয়ে আসছে। 

সহজ উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। কোনো পানির ট্যাপে এক দিকে নীল আর অন্য দিকে লাল থাকলে, সহজেই বুঝে নেওয়া যায় যে নীল দিকে ট্যাপ ঘুরালে ঠান্ডা আর লাল এর দিকে ট্যাপ ঘুরালে গরম পানি বের হবে ট্যাপ থেকে। এখানে আমরা রঙকে তাপমাত্রার সাথে যুক্ত করছি, খুব সহজেই। 

এ ধরনের বোধ অনেক সময় মনস্তাত্ত্বিক শিখন প্রক্রিয়ার ভেতর তৈরী হয়, অনেক সময় সামাজিক চর্চার মাধ্যমে তৈরি হয়। আবার এই ধারণা ও অনুভূতিগুলো স্যাটেলাইট, ছাপাঅক্ষর ও মাইগ্রেশনের বদৌলতে আমদানি-রপ্তানিও হয় অপরাপর সমাজ, রাষ্ট্র, গোষ্ঠীতে।

যেমন, সবুজকে ধরা হয় প্রাচুর্যতা, সমৃদ্ধি, শান্তি ও প্রকৃতির রঙ হিসেবে। কেননা, অতীত এবং বর্তমানের বনবাসী মানুষের কাছে সবুজ অরণ্য খাদ্যের যোগানদার। ইংরেজি শব্দ Green এসেছে Grow শব্দটি থেকে। আবার, হলুদ রঙকে সমাজে দেখা হয় সতর্কতা হিসেবে, কারণ সব রঙের মধ্যে এর দৃশ্যমানতা সবচেয়ে বেশি। একারণে বিপদজনক  চিহ্ন, নিউক্লিয়ার চিহ্ন বা ট্যাক্সির রঙ হলুদ যাতে তা মানুষের চোখে সরাসরি আঘাত করতে পারে। লালকে দেখা হয় সবচেয়ে আকর্ষণীয়, আবেদনময়, সবচেয়ে দুধর্ষ রঙ হিসেবে। আবার আমাদের শরীরের বহমান রক্তের রঙ লাল, তাই লালকে আমরা আমাদের আদিমতা বা পশুসত্ত্বার সাথেও যুক্ত করি। লাল রঙ এতই ব্যবহৃত যে পৃথিবীর শতকরা ৭৫% দেশের পতাকায় লাল আছে। অনেক জেলখানার দেয়ালে গোলাপি ব্যবহার করা হয় কারণ ধারণা করা হয় এই নরম রঙটি মানুষের মধ্যকার হিংস্রতা কমায় (যদিও পরবর্তীতে গবেষণায় এটা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে)। এই একই গোলাপিকে আবার কোরিয়াতে দেখা হয় বিশ্বাস বা ভরসার রঙ হিসেবে।

তাহলে কোনো রঙকে দেখে এমন বিশেষ কিছু অনুভব করা বা করানোটা কি ভুল? কোনো রঙ কি আমরা শুধু পছন্দের খাতিরে পছন্দ করতে পারবোনা? কালো হুডিটা ফেলে আজই নিয়ন সবুজ হুডি অথবা যাত্রাবিরতির পটচিত্র ঘরানার রঙিন জামা কিনে আনতে হবে? নীল রঙ দিয়ে ছবি আঁকার আগে প্রতিবার বাধ্যতামূলক ক্ষমা চাইতে হবে নীলচাষীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে? 

উত্তরটা হলো না, আমাদের সকলের পছন্দ-অপছন্দের রঙ থাকবেই। বিভিন্ন রঙকে নানান জিনিস, আইডিয়া, বোধের সাথে যুক্ত করার চর্চা থাকবেই। কিন্তু সেটার পাশাপাশি আমরা এটাও মাথায় রাখতে পারি যে আমরা বিভিন্ন রঙ দেখে যেরকম প্রতিক্রিয়া দেখি নিজেদের ভেতর, তা অনেকাংশেই সাংস্কৃতিক বা সামাজিক নির্মাণ। অর্থাৎ, একটা সংস্কৃতিতে লম্বাসময় কোনো চর্চার মাধ্যমে কিছু ভাবনা, কিছু সম্পর্ক আমরা নির্মাণ করেছি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নববর্ষের রঙ হিসেবে লাল-সাদাকে বিশেষায়িত করা। বিভিন্ন কারণে নববর্ষের সময় লাল ও সাদার ব্যবহার হয়ে আসছে একটা সময় ধরে, তাই লাল-সাদা একত্রে দেখলে আমরা তাকে নতুন বছর/বাঙালিয়ানার সাথে তাকে সংযুক্ত করি। 

এই পুরো লেখার উদ্দেশ্য কোনো রঙকে ভালো বা খারাপ বলা নয়, যারা বলে তাদের ধরে পানিতে ফেলে দেওয়াও নয়। বরং এই দিকে রঙের দুনিয়া যে কত জটিল এবং এর ব্যবহারের রাজনীতি যে কত গভীর ও ডাইনামিক সেদিকে আলোকপাত করাই ছিল এ লেখার লক্ষ্য। রঙের ব্যবহারের হায়ারার্কি বিরোধী আন্দোলন যেমন হিপি মুভমেন্টের বাটিকের “ট্রিপি” রঙকে আপন করে নেওয়া থেকে শুরু করে এ দেশে রিকশা পেইন্টিং এর রঙের (বা বলা চলে সে রঙে রাঙ্গানো উঁচু দামের পণ্য) নতুন সমাদর, এসব কিছুই আলোচনা-সমালোচনা ও জটিলতার ঊর্ধ্বে না। মোটকথায়, রঙ বিষয়ে যা-ই আমাদের চোখে ধরা পড়ে সব সময়ই ভেবে দেখা উচিত, লাল না হয়ে নীল হলো কেন। 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।